তৎকালীন বাঙলার আসাম ও সোনারগাঁওয়ে ইবনে বতুতার আগমন হয় ১৩৪৫-৪৬ খৃষ্টাব্দে। ইবনে বতুতার বিশ্ব ভ্রমণের অনেকাংশ জুড়েই ছিল সুফি-ফকিরদের আলাপ-আলোচনা।
তৎকালীন বাঙলা অঞ্চলেও তার সফরের মূলে ছিলেন একজন সুফি পীর। তিনি হচ্ছেন শাহজালাল র.। সে হিসেবে ইবনে বতুতার বাংলাদেশ ভ্রমণের উপাখ্যান মূলত শাহ জালাল র. এর-ই আলোচনা।
তবে বাদবাকি আলাপ-সালাপ ও বাংলার রাজনীতি নিয়ে ইবনে বতুতার সংক্ষিপ্ত ধারা বর্ণনা তার বিখ্যাত সফরনামা ‘তুহফাতুন নাজ্জার ফি গারা-ইবিল আমসার, ওয়া আজা-ইবিল আসফার’ গ্রন্থে বাদ যায়নি।
কারণ, দেশের সঙ্গে মানুষ ও শাসনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবেই এগুতে থাকে সবসময়। ইবনে খালদুন বলেন, বিশ্ববাসী জাতি ও জনগোষ্ঠী সমূহের অভ্যাস, অবস্থা ও ধর্মপালন চিরকাল এক অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয় ধারায় চলে না।
যেমন, ভূ-পৃষ্ঠ, সময়-কাল ও রাজ্য-সাম্রাজ্যের কোন স্থিতি নেই। এটাই মহান আল্লাহর নিয়ম। এই পরিবর্তনের বড় কারণ হচ্ছে, প্রত্যেক সমাজ ও জনগোষ্ঠীই কম-বেশি শাসক-প্রশাসক দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাদের অনুসরণে চলতে বাধ্য হয়।
ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায়। তাতে এই বিজ্ঞানসম্মত কথাটিরই যথার্থতা প্রমাণিত হয়— الناس علي دين ملوكهم – আন্নাসু আলা দিনি মুলু-কিহিম – ‘জনগণ তাদের শাসক-প্রশাসকদের আদর্শ ও রীতি-নীতিই সাধারণভাবে মেনে চলে’।
সুতরাং ব্যাক্তিজীবনে রাজনীতির সরাসরি সম্পৃক্ততা কারও না থাকলেও রাজনীতি জনমানুষের কাছে অক্সিজেন-হাইড্রোজেন’র মতো। হয়তো আপনি শ্বাস নেবার সময় বাতাস টের পাচ্ছেন কিংবা শ্বাস ফেলবার সময়।
বাংলার পথে
ইবনে বতুতা যখন শ্রীলঙ্কা থেকে অ্যাডাম’স পিক দেখে ফিরছেন তখন তাদের জাহাজ বাতাসের কবলে পড়ে। এরপর তারা মালাবার যান এবং সেখান থেকে ফেরার পথে ডাকু দলের খপ্পরে পড়েন। সঙ্গে থাকা সব কিছু রেখে দেয় ডাকাত দল। নামিয়ে দেয় উপকূলে।
ইবনে বতুতা বলেন, ‘শুধু সালোয়ারটা গায়ে রেখেছে ওরা!’ এরপর কোনমতে কালিকট যান। সেখানে কিছুদিন থেকে এরপর মালদ্বীপে তার পুত্রশিশুকে দেখতে শ্বশুরালয়ে যান। অতঃপর জাহাজে করে রওয়ানা হোন বাঙাল মূলুকের উদ্দেশ্যে।
যাবেন প্রখ্যাত এক বুজুর্গের সাক্ষাতে। প্রায় পয়তাল্লিশ দিন পর তারা চাটগাঁ (চট্টগ্রাম) বন্দরে নোঙর করেন।
ইবনে বতুতা বাঙাল মুলুকের স্মৃতিচারণ করতপ গিয়ে বলেন- ‘আমরা চাটগাঁ নামলাম, বিশাল এক শহর। গঙ্গা এবং যমুনার মোহনা সাগরে এসে নেমে গেছে এখানে। এখানকার নদীতে যুদ্ধজাহাজ আছে অনেক। লৌখনৌতির সঙ্গে এদের যুদ্ধ হয়। এখানে চালের মূল্য খুব সস্তা। কিন্তু এই অঞ্চল অন্ধকার।
খোরাসানে প্রবাদ আছে, ‘দোজখত্ পুর নি’মাত; নেয়ামতে ভরপুর এক দোজখ।’ হয়তো তিনি শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসরতা বুঝাতে ‘অন্ধকার’ বলেছেন। কিংবা এত সুন্দর এক দেশে অথচ রাজনৈতিক কারণে থাকতে পারছেন না তিনি!
বাংলার অর্থনীতি-ই এর সর্বনাশ!
তিনি এখানকার জিনিসপত্রের একটা তুলনামূলক দাম উল্লেখ করেছেন। এক কথায় এখানকার জিনিসপত্রের সস্তা মূল্য দেখে তিনি পুরোই অবাক বিস্মিত ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তবুও নাকি এই দাম তাদের নিকট অনেক বেশি!’ সফরনামা’র আধা পৃষ্ঠা জুড়ে শুধুই জিনিসপত্রের দাম তুলে ধরেছেন। তার কাছে বিষয়টা যতটা আনন্দদায়ক ছিল, আমাদের মতো ইতিহাসের পাঠকদের জন্য ঠিক ততটাই বজ্রাঘাত ছিল শান্তিপূর্ণ জীবন ধারণকারী মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে।
কারণ, কিছু কিছু গবেষকের মতে, ইবনে বতুতার বই আরবী থেকে ল্যাটিনে অনুবাদ হবার পর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সূত্রপাত ঘটে এই উপমহাদেশে। যদিও আগমনের ধারাবাহিকতায় ওলন্দাজ, পর্তুগীজ ও ফ্রান্সের বণিকদের আগমন ইংরেজদের আগেই হয়। আর আরব বণিকদের যাত্রার কথা তো সুপ্রাচীন। কিন্তু তাদের মনে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মানসিকতা ছিল না।
তিনি আকস্মিক বাংলায় আসেননি
ইবনে বতুতার বাঙাল মুলুকের সফরের ব্যাপারে অনেকের ধারণা, নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে আকস্মিক তিনি বাংলায় এসেছেন। এমন ধারণা ভুল, এইচ আর গিব এখানে সফল।
কারণ ইবনে বতুতার সফরনামা’র পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ তিনি করেননি। আর ইবনে বতুতার বাঙ্গালী পাঠকসমাজ তাকে, হয় ইংরেজি থেকে পাঠ করেছে নয়তো বঙ্গানুবাদের দারস্থ হয়েছে।
অথচ ইবনে বতুতা নিজেই বলছেন, আমার পূর্বে এখানে আমার স্বদেশী মাহমুদ আল মাসমুদী বসবাস করেছেন; বাংলায়৷ আমার মনে হয়, তিনি স্বদেশীর কাছ থেকে বাংলার কথা শুনেই এখানে আসেন এবং শাহ জালাল র. এর সাথে সাক্ষাত করেন।
এইচ আর গিব বলেন, ‘ইবনে বতুতার বিশ্ব সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বুজুর্গ-অলি আওলিয়ার সাথে সাক্ষাত করা।’
যারা আকস্মিক সফরের সুর তুলেছেন তাদের বক্তব্য সম্ভবত মালদ্বীপ সফরে যাবার সময়ে হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের সফর বাতিল হওয়া এবং এরপর বাংলায় সফর করা- এতটুকুই। অথচ এটা কোন ভিত্তি হতে পারে না। কারণ, তিনি বাঙাল মুলুকের সম্যক ধারণা নিয়েই এখানে এসেছিলেন। পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ইবনে বতুতার জবানে সফরবৃত্তান্ত; আঞ্চলিক রাজনীতি
এবার ইবনে বতুতার জবানে শুনে নেয় তার বাঙাল মুলুক সফরের উদ্দেশ্য – ‘চাটগাঁ আসলাম। সেখানের সুলতানকে আমি দেখি নাই। তার সঙ্গে আমার সাক্ষাতও হয় নাই। আমি জানতে পেরেছিলাম, এই সুলতান দিল্লির সম্রাটের সঙ্গে বিদ্রোহ করেছে। তাই, এখানে অবস্থানের পরিনতির চিন্তা করে আশংকা করি এবং দ্রুত আমি সেখান থেকে কামরুপ পাহাড়ের উদ্দেশে রওয়ানা করি। পাহাড়টি খুব দীর্ঘ।
চীনের সাথে গিয়ে মিলেছে এবং তিব্বতেও এর অংশ আছে, যেখানে মৃগনাভির সন্ধান পাওয়া যায়। কামরুপের মানুষগুলো দেখতে তুর্কিদের মতো হয়। এরা যাদুবিদ্যা জানে। এখানকার পুরুষদের গায়ে প্রচুর শক্তি। অন্যান্য স্থানের পুরুষদের তুলনায় দিগুণ। এই পাহাড়ের দিকে আমার রওয়ানার উদ্দেশ্য সেখানকার প্রখ্যাত পীর শেখ জালালুদ্দিন তিবরিজীর সাথে সাক্ষাত করা।
ওপরের বিবরণীতে ইবনে বতুতার কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আঞ্চলিক রাজনীতিতে রাজদরবারের অবস্থান। সমাজিক অবস্থান। বিভিন্ন স্থানের রীতিনীতি, সাংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধান।
কিন্তু তার এই ছোট্ট ধারা বর্ণনার যাত্রাপথের শেষ গন্তব্য, তিনি যাচ্ছিলেন শায়খ জালালুদ্দিন তিবরীজির সাথে সাক্ষাত করতে। আমার ধারণা, ইবনে বতুতার বাংলা সফর আরও দীর্ঘ হতো যদি না তিনি দিল্লির রাজদরবারের ভয় পেতেন।
কারণ, বাংলার সুলতান নিজেদের স্বাধীন ঘোষনা করে রাজনৈতিকভাবে সম্রাটের সাথে বিদ্রোহ করেছিল। তাছাড়া, ইতোপূর্বে তিনি দিল্লির রাজকীয় পদে চাকুরী করেছেন এবং পরবর্তীতে সম্রাটের রাজদূত হয়ে চীন সফরে গিয়েছেন। এটাই রাজনীতির দরদাম এবং নিরীহপন্থার সহজ নির্বাচন।
শ্রীহট্টে শাহ জালালের দরগায়!
শাহ জালালুদ্দিন র. এর স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে ইবনে বতুতা বলেন, আমরা কামারূপ পাহাড় পাড়ি দিয়ে আসি এক বুজুর্গ লোকের সাথে দেখা করতে। তিনি ছিলেন শেখ জালালুদ্দিন। আল্লাহ ওয়ালা, দরবেশ। তার অনুসারী নিয়ে তিনি গুহায় থাকতেন। দশ দিন পরপর নিজ গাই গরুর দুধ দিয়ে ইফতার করতেন। তার একমাত্র সম্পদ ছিল এই গাভী। সেখানকার লোকেরা তাকে অত্যান্ত সম্মান করত। হিন্দু মুসলিম সবাই তার কাছে হাদিয়া তোহফা নিয়ে আসত। এগুলো দিয়েই তার অনুসারীদের খাবারের প্রয়োজন মিটে যেত।
কিন্তু শাহজালাল (র.) দশদিন পরপর ইফতার করতেন। খাবার ছিল সেই গাভীর দুধ। তিনি প্রতিটি রাত-ই নামাজে কাটিয়ে দিতেন। হালকা-পাতলা গড়নের লম্বা দেহের মানুষ ছিলেন তিনি। পাহাড়ের লোকগুলো তার কাছে ইসলাম কবুল করা’য় তিনি সেখানেই থেকে যান।
ইবনে বতুতা বলেন, শেখ জালালুদ্দিনের অনেক কারামত ছিল। তার এক শাগরেদ আমাকে শুনিয়েছে, মৃত্যুর আগের দিন তিনি বললেন, আগামীকাল আমি তোমাদেরকে ছেড়ে চলে যাব। আমার প্রতিনিধিত্ব করবেন সেই আল্লাহ যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। পরদিন জোহরের নামাজের শেষ রাকাতের সেজদায় ইন্তেকাল করেন তিনি। তার হুজরাখানার দক্ষিণ পাশে একটি খননকৃত কবর পাওয়া যায়, পাশে কাফনের কাপড়। শাগরেদরা সেখানেই তার কাফন-দাফন ও জানাজা করেন।
আরেকটি কারামতের কথা উল্লেখ করেন ইবনে বতুতা, তখনও শেখ জালালুদ্দিন এর দরগা থেকে আমার অবস্থান দুইদিনের পায়ে হাঁটা পথ। পথে তার চার শাগরেদর সাথে আমার সাক্ষাত।
তারা বলল, শায়েখ তার নিকট উপস্থিত ভিক্ষুদের বলেছেন, মরক্কোর এক লোক আসছে। তোমরা ইসতেকবাল করে তাকে নিয়ে আসো। এই উদ্দেশ্যেই এই চারজন এসেছে। তাদের সাথে শায়েখের দরগায় গেলাম। গুহার বাহিরে ছাওনি করা। আশপাশে কোন ঘর নেই। এলাকার লোকেরা তার কাছে আসত। কি মুসলিম কি কাফির; সবাই আসত। হাদিয়া তোহফা যা আসত সবগুলোই ব্যায় হতো ভিক্ষু ও আগন্তুকদের জন্য। শায়েখ তার গাভীর দুধ খেয়েই জীবনধারণ করতেন।
আমি তার নিকট গেলে তিনিই উঠে এসে আমার সাথে কোলাকুলি করলেন এবং দেশবিদেশের অবস্থা ও সফরের হালহকিকত জিজ্ঞেস করলেন। সবকিছু বলার পর তিনি আমাকে বললেন, তুমি আরবের মুসাফির। তখন তার সঙ্গীরা বলল, আজমেরও মুসাফির। তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি আজমেরও মুসাফির।
এরপর তিনি শাগরেদদের বললেন, যাও, তার মেহমানদারি করাও। তারা আমার তিনদিন মেহমানদারি করায়।
ওপরের দুই কারামতের আলোচনা করে তৃতীয় আরেকটি কারামতের কথা বলেন ইবনে বতুতা। যেখানে এক ঘটনার মাঝে কয়েকটি কারামতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং সবগুলোই ইবনে বতুতার সাথে সংশ্লিষ্ট।
ইবনে বতুতা বলেন, চীনে শায়খ জালালুদ্দিনের বন্ধু শায়খ বুরহানুদ্দিন সাগরিজি’র সাথে সাক্ষাতকালে তাকে শায়খ জালালুদ্দিন এর কারামতের কথা বললে তিনি বলেন, আমার ভাই জালালুদ্দিন এরচেয়ে বড় কিছু। এরপর তিনি আমাকে শুনিয়েছেন, আমার কাছে খবর এসেছে, জালালুদ্দিন প্রতিদিন ফজরের নামাজ বায়তুল্লাহ শরিফে আদায় করতেন এবং প্রতি বছর-ই হজ্জ করতেন। আরাফার দিবসে এবং কোরবানির দিন তাকে খুঁজে পাওয়া যেত না।
শায়খ জালালুদ্দিনের জন্মস্থান ছিল ইয়েমেনের কোনিয়া শহরে। এজন্য তাকে শাহজালাল ইয়ামানী বলে ডাকেন। এটাই প্রসিদ্ধ। তবে কেউ কেউ তাকে তুরষ্কের কোনিয়া প্রবাসী হিসেবে ধারণা করেন। যার আরেক নাম তিবরিজ। সেজন্য ইবনে বতুতা-ও তাকে ‘তিবরিজি’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। শায়খ জালালুদ্দিন এর মৃত্যু ১৩৪৭ সনে হয়েছিল।
ইবনে বতুতা বলেন, এক বছর পর চীনে থাকাকালীন সময়ে আমি তার মৃত্যু সংবাদ পাই।
সোনারগাঁওয়ের পথে ইবনে বতুতা; এক দরগা থেকে আরেক দরগায়!
শাহ জালাল র. এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকাযোগে তারা রওনা হোন সোনারগাঁও’র পথে। টানা পনেরদিন চলার পরে সোনারগাঁও এসে পৌঁছান তারা। সুরমা নদীর নীল টলমলে পানি ও এর দুই পাশের সজ্জিত বাগান, পানি তোলার চরকা ও গ্রাম দেখে মুগ্ধ হন ইবনে বতুতা।
মিশরের নীল নদের সাথে এর তুলনা করেন তিনি। বলেন, এই নদী ধরে বঙদেশ ও লখনৌতি যাওয়া যায়। নদীর দু’ধারের অধিবাসীরা কাফের। মুসলিম শাসককে কর দিয়ে বসবাস করে তারা।
নদীর দু’ধারের অপরূপ সুন্দর গ্রাম ও বাগানের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মনে হচ্ছিল বাজারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নদীতে অনেক নৌযান। নদী পারাপারের জন্য সুফি-দরবেশদের থেকে কোন ভাড়া নেয়া হয় না। সুলতান ফখরুদ্দিনের আদেশ এটা। বরং যার পাথেয় নেই তাকে পাথেয় জোগাড় করে দেবার নির্দেশ আছে তার থেকে। আর যখন সুফি-দরবেশ শহরে পৌঁছায় তাকে অর্ধ দিরহাম প্রদান করা হয়। পনেরো দিনের সফর শেষে আমরা সোনারগাঁও পৌঁছলাম।
এরপর ইবনে বতুতা সেখানে কী করেছেন তার উল্লেখ আমার কাছে রিহলা’র যতগুলো কপি আছে তাতে কিছুই পাইনি। তিনি বলেন, আমরা একটি জাঙ্ক দেখলাম। জাভা’য় রওনা হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাতে চড়ে আমরা সে উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
সোনারগাঁও ইবনে বতুতা কেন এসেছিলেন তার উল্লেখ স্পষ্টভাবে ইতিহাসে পাওয়া মুশকিল। তবে ধারণা করা হয়, বুজুর্গদের প্রতি তার আসক্তি তাকে এখানে টেনে এনেছিল।
কারণ, ইবনে বতুতা এখানে আসার প্রায় অর্ধ শতক আগে সোনারগাঁওয়ে ছিলেন উপমহাদেশে ইলমে হাদিসের প্রথম মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা র.। ১৩০০ সনে তার ইন্তেকাল হয়। আর ইবনে বতুতা বাংলা সফর করেন ১৩৪৫-৪৬ সনে।
শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার মাজার শরীফ বর্তমানে নারায়নগঞ্জের মোগড়াপাড়া। ইব্রাহিম দানিশমান্দ এর মাজারও সেখানেই আছে।
ইবনে বতুতার সোনারগাঁও সফরকালে বাঙলার তৎকালীন সুলতান ছিলেন ফখরুদ্দিন। তিনি শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা’র-ই কোন শাগরেদ বা শাগরেদের শাগরেদ হবেন হয়তো!
সুফিদের প্রতি সুলতানের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা-ই প্রকাশ করে এসব বুজুর্গের কতটা প্রভাব ছিল সুলতানের মাঝে। শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (র.) হাদিসের পাশাপাশি অধিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের উপর পাঠদান করতেন।
তার ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। তার ছাত্ররা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ছিলেন। কিংবা তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশায় যুক্ত হতেন। পনেরো শতাব্দীতে আবিষ্কৃত এক শিলালিপিতে সোনারগাঁও’র কিছু সরকারি আমলার নাম পাওয়া যায়, যাদের নামের শুরুতে ছিল ‘মুহাদ্দিস’ শব্দ।
কথিত কথা’র আলাপন
ইবনে বতুতার সফরনামার সূত্রে আবুল হাসান আলী নদভী মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা’র কথা উল্লেখ করেছেন। হয়তো উল্লিখিত বিষয়সহ ইবনে বতুতার সফরনামা’র এমন কোন এক কপি তিনি পেয়েছেন, যা আমাদের হস্তগত হয়নি।
শেষ কথা
ইবনে বতুতার চোখে ‘প্রাচুর্যে ভরপুর এক দোজখ’ এই বাংলা। সব আছে তবুও অন্ধকার। হয়তো এমন মন্তব্য নিজের অসহায়ত্বের দিকে তাকিয়ে তিনি করেছেন।
যেহেতু দিল্লির রোষানলে পড়তে পারেন তাই এত নিয়ামত থাকতেও ভোগ করার সুযোগ কই তার! ফলে আমরাও অনেক তথ্য-ই পাইনি তার থেকে। তিনি এই অঞ্চলকে দেখেছেন, সমৃদ্ধশালী। উর্বর। জীবাশ্মে ভরপুর।
এখানকার ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষগুলোর সহাবস্থানও তিনি দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন জ্ঞানীর প্রতি রাষ্ট্রের কদর ও আদর যত্ন। তার সমাজবিজ্ঞানী চোখ একটু একটু করে খুট খুট করে সবই বলে দিয়েছে। সংক্ষেপে বিস্তারিতভাবে।
সমৃদ্ধশালী সমাজ বিনির্মানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আমাদের উচিত শক্তির উৎস সমূহ খুঁজে বের করা। হতাশার কিছু নেই, পৃথিবী সম্ভাবনাময় জগত। নতুবা পূর্ব পুরুষের মতো আরও দীর্ঘকাল আমরাও ‘প্রাচুর্যে ভরপুর দোজখে’ই বসবাস করতে থাকব!
তথ্য সূত্র:
●তুহফাতুন নাজ্জার ফি গারাইবিল আমার ওয়া আজাইবিল আসফার- ইবনে বতুতা
●ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা(সংক্ষিপ্ত বাংলা) – এইচ এ আর গিব
●শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা, উপমহাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস- মওলবি আশরাফ
●বাংলাপিডিয়া
●উইকিপিডিয়া
●ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত কিছু প্রবন্ধ
●ইসলামের ইতিহাস দর্শন- মাও. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম