৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের দিন ছিল ১০ ডিসেম্বর। প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রচারে রাজধানীর অলিগলি সরগরম হয়ে উঠেছে। এই পরিবেশ কতক্ষণ বজায় থাকে তা নিয়ে নগরবাসীর রয়েছে শঙ্কা। এর মধ্যেই দলীয়ভাবে মনোনয়ন পাওয়ার পর বিএনপির এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ বলছে, তার বিরুদ্ধে আগেই গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু দেশবাসী ভুলে যাননি, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশ কিভাবে বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে ‘গায়েবি মামলা’ করেছিল। তাই অতীত অভিজ্ঞতায় বলা যায়, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে; সরকারবিরোধী সম্ভাবনাময় প্রার্থীরা ততই হয়রানির শিকার হবেন। একই সাথে বিরোধী নেতাকর্মীরা যাতে নির্বিঘেœ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলাবিহিনী পদে পদে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। এবার মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময়ই বিভিন্ন প্রার্থীর বিরুদ্ধে জনসমাগম ঘটিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ইসি ছিল নির্বিকার। শুরুতেই প্রার্থীদের আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করতে পারবে ইসি, এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। আর নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য ‘নির্বাচনী সমতলী মাঠ’ তৈরির যে অঙ্গীকার ও দায়িত্ব ইসির রয়েছে, তা কতটা কার্যকর হবে তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ।
নির্বাচনী আচরণবিধি কেউ লঙ্ঘন করলে ইসির পদক্ষেপ দৃশ্যমান হতে হবে। তা না হলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে না। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি না থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, প্রচার শুরুর সাথে সাথে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে কমিশনের তরফে কড়া বার্তা না থাকলে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। শুরুর ঘটনাগুলো ছোট হলেও পরে বড় অঘটন ঘটতে পারে। বিধি লঙ্ঘন করলে প্রার্থী বা তার সমর্থকের, এমনকি তার দলেরও জরিমানা করার বিধান রয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি এসব বিধিবিধানের তোয়াক্কা নিকট অতীতে করেছে বলে দেখা যায়নি; বরং ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতে ব্যালট বাক্স ভরার সংস্কৃতিই তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পারের সবচেয়ে পছন্দনীয় উপায়, এটি এখন অনস্বীকার্য সত্য। এখনই অভিযোগ উঠেছে, সরকারদলীয় এক মেয়রপ্রার্থী আচরণবিধি মানছেন না। প্রতীক বরাদ্দের আগেই বিধি লঙ্ঘন করে প্রচার চালানোর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলতে বলা হলেও অনেকে তা লঙ্ঘন করছেন। এ নিয়ে ইসির ভূমিকা দায়সারা গোছের। তাই ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সবার মনে সংশয় দানা বাঁধছে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িক ফিল্ড তৈরিতে ইসি কতটুকু আন্তরিক? একই সাথে ইভিএমে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করতে সিইসির অনড় অবস্থানে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। তাদের বক্তব্যÑ ইভিএম নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়াটাই আসল বিষয়।
ইতোমধ্যে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা বলছেন, ভোট স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করার দায়িত্ব ইসির। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিএনপির মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ, ‘নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন, নখদন্তহীন ভূমিকা রাখছে। তিন দিন আগে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’ দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী পোস্টার টানানোতে ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না। বিষয়টি কারো নজর এড়ায়নি। এই দৃশ্যমান আলামত থেকে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে? অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা এ ব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু আমাদের দেশে ভোট গ্রহণ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। গত এক যুগে নির্বাচনব্যবস্থার ভঙ্গুরতা স্পষ্ট। ক্ষমতায় থেকে পরাজিত না হওয়ার মানসিকতা এবং ইসির যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে না পারাই এর জন্য দায়ী।
যেহেতু একটি নির্বাচন আয়োজন করতে হচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে কিছুটা দায়িত্ব নিতেই হবে। সেই দায় থেকে ইসি একটি দৃশ্যমান সমতাভিত্তিক নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে এগিয়ে আসবে, ঢাকাবাসীর এমনটিই প্রত্যাশা।