নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হলো বহু প্রতীক্ষিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠক। এই বৈঠকটা গুয়াহাটিতেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় বৈঠকটা পিছিয়ে যায়। কেননা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সরকারের একটা উদযাপনের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আরো বেশ কিছু মন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তাতে আমার কাছে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। একটা বিষয় হলো, দুই দেশের ৫৪টি নদী আছে, যে ব্যাপারে একটা অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং সে ব্যাপারে দ্রুত এগোনো। কেননা এ ব্যাপারে কোনো অভিন্ন নীতি না থাকায় দুই দেশেরই নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর জল অথবা পানি, সে আপনি যে নামেই ডাকুন না কেন, যদি তার প্রবাহ ব্যাহত হয় তাহলে তো দুটি দেশেরই উন্নয়ন, সভ্যতা সব কিছুই তাতে ধাক্কা খায়। এ ছাড়া যে নদীটিকে নিয়ে, যে চুক্তিটিকে নিয়ে এত বিতর্ক, যেটা আজও হয়নি সেই ৫৪টি নদীর মধ্যে তিস্তার বিষয়টিও তো থাকে। তিস্তা নিয়েও ভারত সরকার ঢাকাকে আশ্বাস দিয়েছে যে আবার নব কলেবরে এগোনো হবে। তবে সেটা নিয়ে আগাম প্রচার করাটা কূটনৈতিকভাবে মোটেই সুকৌশল নয়। তাই দুই দেশই এই বিবৃতিতে সে শব্দটি অনুচ্চারিত রেখেছে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতের নিজেদের দিক থেকে একটা উদ্যোগ নেওয়া, যেটা জয়শঙ্কর বলেছেন। এই বিষয়টি নিয়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিঞ্চিৎ ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে যাচ্ছিল। তার কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের যে সম্পর্ক সেখানে মিয়ানমারের সরকারের ওপর চাপ দিয়ে এ ব্যাপারে ভারত একটা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেবে এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে দায়িত্ব নেবে—এটা বাংলাদেশ আশা করে। এরই মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলা বাংলাদেশে গিয়ে এ ব্যাপারে অঙ্গীকারও করে এসেছেন। কিন্তু সেটার ফলোআপ হচ্ছে না, এমন অভিযোগ বাংলাদেশের তরফ থেকে বারবার করা হয়েছে এবং ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারত যে লিখিতভাবে বিবৃতিটা রাখল, তার ফলে দায়বদ্ধতাটা এখন শুধু মুখের নয়, এটা এখন জয়েন্ট রেজুলেশনের একটা অঙ্গ হয়ে গেল, যেটা কূটনৈতিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
সেদিনের আলাপ-আলোচনায় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমেরিকা এবং এই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন, বিশেষত ইউক্রেনের পরিপ্রেক্ষিতে।
এমন একটা সময় এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হলো, যার ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ ১৮ জুন যখন ভারতের বণিক সভা সিআইআই, দুই দেশের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে নয়াদিল্লির পাঁচতারা হোটেল তাজ মানসিংহর শাহজাহান কক্ষে আয়োজন করল এক যৌথ সভার, তার ঠিক আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মা হীরাবেন মোদির জন্মদিনের শতবর্ষ পালন উপলক্ষে পাঠালেন ১০১টি লাল গোলাপের গুচ্ছ। তার ঠিক এক দিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দর কাছে পৌঁছল এক হাজার কিলো আম্রপালি আম। একেই বলে কূটনীতি।
এরপর যখন বৈঠক হলো এবং সেই বৈঠকে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী একান্তে আলোচনা করলেন তখন সেখানে কোন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হলো তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের আগে একটা কথা বলতে হবে যে এই দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন আলোচনায় বসলেন তখন সেখানে সব কিছুই উঠে এলো তাঁদের সেই আলোচনায়। সেখানে যেমন বাণিজ্য, পরিবহন, পরিকাঠামো ইত্যাদি ইকোনমিক-ডিপ্লোম্যাসি গুরুত্ব পেল। আবার এলো পাবলিক-ডিপ্লোম্যাসি, নিরাপত্তা, ইউক্রেন সমস্যা, ভারত ও বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আরো কত কিছু।
সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরেরও নীলনকশা তৈরি হয়েই রয়েছে। এই বৈঠকে এই সফরসূচি চূড়ান্ত করার বিষয়টি দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনার বিষয় নয়। এটা তো এখন ঠিক হবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার এখনো জানায়নি যে ঠিক কবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসবেন। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। যখনই বিষয়টা চূড়ান্ত হবে তখনই আমরা সব জানাব। এখন এই বিষয়টি শীর্ষস্তরে আলাপ-আলোচনার মধ্যে রয়েছে। কাজেই যাঁরা মনে করছেন যে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে শেখ হাসিনার সফরসূচি চূড়ান্ত হচ্ছে, তাঁরা ভুল করছেন। তার কারণ, নীতিগতভাবে শেখ হাসিনার ভারত সফরের দিনক্ষণ নিয়ে আলোচনার জন্য দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের প্রয়োজন হয় না। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের অনেক বেশি প্রয়োজন হয় সেখানে, যেখানে জটিলতা আছে, যেখানে সমস্যা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো তারা ভারতকে জানাতে চাইছে সেইগুলো।
আসলে বৈঠকের অন্দরে ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়ে দিলেন যে এই এই বিষয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমস্যা। সেগুলো অবশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে বলার বিষয় নয়। দুটি দেশ, যারা পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই একাত্তর সাল থেকে জড়িয়ে রয়েছে, তারা নিজেদের মধ্যে সেগুলো বিচার-বিবেচনা করবে। প্রকাশ্যে এই উপমহাদেশের রাজনীতি কূটনীতিতে সেই বিরোধাভাসটা সামনে তুলে আনাটা কাজের কথা নয়। তবে কূটনৈতিক দর-কষাকষির প্রশ্নে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশের ইস্যুগুলো তিনি ভারতের কাছে পেশ করেছেন। সেখানে জ্বালানির বিষয় আছে, সংযুক্তির বিষয় রয়েছে, পানিসম্পদ বণ্টনের বিষয় রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের সহযোগিতার বিষয় রয়েছে। আগে এসব জটিল ও গোলমেলে ব্যাপারগুলো আলোচনার মাধ্যমে বরফটা গলিয়ে দিয়ে প্রটোকল আর কূটনৈতিক সৌহার্দ্য কী করে করতে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন, তিনি কিন্তু দুদিনের দিল্লি সফরে এসে সেটাও বুঝিয়ে দিলেন।
বৈঠকে জয়শঙ্কর ও আব্দুল মোমেনের যে শরীরী ভাষা এবং রসায়ন, তাতে কিন্তু মনে হয়েছে, এ ধরনের আচরণ কিন্তু অনেক জটিল সমস্যারও সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।
গত বছর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হয়েছে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রামনাথ কোবিন্দ থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি, কে না গেছেন ঢাকায়? জয়শঙ্কর বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি দিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তার ফলে এই মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন যখন আমেরিকা ও রাশিয়া যুযুধান দুই পক্ষ তখন ভারত কিন্তু একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে। চীন ও আমেরিকা কারোরই ফাঁদে পা না দিয়ে সার্বভৌম বিদেশনীতিকে প্রতিষ্ঠা করা যে কত কঠিন কাজ সেটা ভারত বুঝতে পারছে।
একজন কূটনীতিক বলছিলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তারা যে সার্বভৌমত্ব দেখাচ্ছে সেটার জন্য তাদের লাখো সালাম। তার কারণ, কাজটা সোজা নয়। শ্রীলঙ্কা কিন্তু এটা পারেনি। তারা তো ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। ভারত বৃহৎ দেশ, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে মোমেন যখন পাটের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিংয়ের বিষয়টি তুলছেন, যখন জ্বালানি-নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলছেন, পানিবণ্টনের প্রশ্ন তুলছেন, সমুদ্রবন্দরের চারটি রুটে চারটি পরীক্ষামূলক পণ্য পরিষেবা চালু করার ব্যাপারে সমস্যাগুলো বলছেন তখন কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টা যথেষ্ট জোরালো কণ্ঠস্বরে বাংলাদেশ ভারতকে জানাচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান—এসব দেশের জ্বালানি খাতে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতেই হবে। আর এই জ্বালানি নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রশ্নটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব কিন্তু বারবার উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশকে ভারত গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু নিরাপত্তার বিষয়ে নয়, অর্থনীতির বিষয়েও বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষের জিনিস কেনার ক্ষমতা যতটা তাতে বাংলাদেশের এক টাকায় যতটা খরচ করতে পারে, ভারতের এক টাকায় সেটা খরচ করা যায় না। এই পারচেজিং ক্যাপাবিলিটিটা যে বাংলাদেশে দারুণ, সেটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও বলছে। এ ছাড়া বৃহৎ দেশ ভারতে মুদ্রাস্ফীতি আরো বেশি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবস্থাটাকে আরো জোরদার করাটা ভারতের জন্যও বিশেষ জরুরি। সেটা অবশ্য সিআইআইয়ের বণিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাও দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে ভারত আশা করছে, এই বৈঠকে শেখ হাসিনার আসন্ন সফরের ক্ষেত্রটা প্রস্তুত হলো। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনে বাংলাদেশ ও ভারত হাতে হাত মিলিয়ে যে এগোবে তার অঙ্গীকারও রচিত হলো রবিবারের এই বৈঠকে। সুতরাং এখন দেখার বিষয় আগামী দিনে কিভাবে দুটি দেশ এগোবে। সব ভালো যার শেষ ভালো।
লেখক : নয়াদিল্লিতে বিশেষ সংবাদদাতা