সবাই কাগজের ওপর ছবি আঁকে; কিন্তু শুরু থেকেই সাদিত খুঁজছিলেন ভিন্ন একটি ক্যানভাস। যেখানে তুলির আঁচড়ে নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন। প্রথম ছবিটি সাদিত এঁকেছিলেন আইসক্রিমের বাক্সের ওপর। তারপর বেছে নিলেন টি-ব্যাগ। সাদিত বলছিলেন, ‘যেকোনো ভিন্ন মাধ্যম কাজের সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। রেগুলার ক্যানভাসেও কাজ করি। তবে এমন একটি ভিন্ন মাধ্যম খুঁজছিলাম, যেখানে ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে পারব। টি-ব্যাগে সে সুযোগ পাওয়া গেল।’ উল্লেখ্য, সাদিতের বাবাও সুন্দর স্কেচ করতে পারেন।
পদ্মাপারের ছেলে
সাদিতের বাড়ি রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর ঝাউতলা এলাকায়। তিনি মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি আর বিবিএ, এমবিএ করেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চার বছর চাকরি করেছেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। এখন তিনি ব্যবসা করছেন। পড়াশোনার বিষয় ছিল না চিত্রকর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই আঁকাআঁকি বিষয়ে। শখের বশেই ছবি আঁকেন। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফ্যাশন হাউস ‘সুন্দর’ অথবা বাসায় নিজের ঘরই সাদিতের আঁকাআঁকির জায়গা।
টি-ব্যাগ যেভাবে ছবির ক্যানভাস
চা খাওয়ার পর টি-ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো কেউ কেউ সার হিসেবে গাছের গোড়ায় দেন। ফেলে দেওয়া টি-ব্যাগ সংগ্রহ করেন সাদিত। জানালেন, টি-ব্যাগ পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। তারপর তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পকর্ম। বিখ্যাত সবাই আছেন তাঁর ছবিতে। সাদিতের তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো লাল-সবুজের পতাকাওয়ালা, শহরের এক কোনে বসে থাকা তরমুজ ব্যবসায়ী, ধর্মীয় সম্প্রীতি, রঙিন কৃষ্ণচূড়া কিংবা কালবৈশাখী ঝড়। পরিবেশ-প্রকৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গল্পও তিনি বলেছেন। টি-ব্যাগের ক্যানভাসে ছবি আঁকার জন্য তিনি অ্যাক্রেলিক রং ব্যবহার করেন।
খালা হলেন অনুপ্রেরণা
সাদিতের সেজো খালা নূর-ই হাফসা পারভীন। তিনি বেতার ও মঞ্চশিল্পী। ব্যতিক্রমী কাজের অন্যতম অনুপ্রেরণা তাঁর এই খালা। সাদিতের খালাও ফেলা দেওয়া বস্তা দিয়ে সুন্দর সব জিনিস বানাতেন। সাদিতের মা শিক্ষকতা করেছেন। সাদিত বললেন, ‘পরিবার থেকে বরাবরই উত্সাহ, অনুপ্রেরণা পেয়ে এসেছি।’
টি-ব্যাগকে ক্যানভাস বানিয়ে নানা কিছু আঁকেন সাদিত
দেশ-বিদেশে
সাদিত বললেন, টি-ব্যাগে ছবি আঁকে এমন শিল্পীর সংখ্যা কম। দেশ-বিদেশে সাদিতের আঁকাআঁকি প্রশংসিত হয়েছে। ফ্রান্সের শিল্পী রুবি সিলভিয়াস যখন বলেন, ‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা, অসম্ভব ভালো আঁকছ তুমি’, তখন গর্বে বুকটা ভরে ওঠে, বললেন সাদিত। তাঁর কাছে জানা গেল, সারা পৃথিবীতে টি-ব্যাগে ছবি আঁকেন এমন শিল্পীর সংখ্যা খুব একটা বেশি না। তাঁদের মধ্যে রুবির কাজ তাঁর খুব ভালো লাগে। তিনিও প্রশংসা করেন আমার টি-ব্যাগ স্টোরিজের। টি-ব্যাগ স্টোরিজ নামে ফেসবুকে একটি পেজ রয়েছে। সেখানে সাদিত তাঁর টি-ব্যাগ শিল্পকর্ম পোস্ট করেন। দেশে টি-ব্যাগে সাদিতই প্রথম ছবি আঁকেন। ২০১৬ সালে তাঁর টি-ব্যাগে ছবি আঁকা শুরু। নিজের আঁকাআঁকি বিষয়ে সাদিত বললেন, ‘আঁকাআঁকিটা আমার আত্মতৃপ্তির জায়গা, সব সময় চাই আমার এই তৃপ্তির জায়গাটা থাকবে শরতের নীল আকাশের মতো।’ টি-ব্যাগ স্টোরিগুলো সাদিত অ্যালবাম আর ফ্রেম করে নিজের কাছে রেখেছেন। সব মিলিয়ে ছবির সংখ্যা চার শতাধিক।
অর্জনও কম নয়
ক্যানভাস ব্যতিক্রমী হলেও সাদিতের অর্জন কম নয়। তাঁর কিছু কাজ গত বছর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে পেনসিল ফাউন্ডেশনের এবং রাজশাহীর ইংক্টোবার প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। এ বছর ময়মনসিংহ কার্টুন ফেস্টে তাঁর কাজের প্রিন্টেড কপি প্রদর্শিত হয়েছে। ইস্পাহানি মির্জাপুর, রূপালী ইনস্যুরেন্স কম্পানির গেল বছরের ক্যালেন্ডারও তাঁর টি-ব্যাগ স্টোরিজ দিয়ে করা হয়েছে। তুরস্কের টি-ব্যাগ ও কফি ফিল্টার পেপার উত্পাদনকারী কম্পানি পেলিপেপারের ক্যাটালগ কাভারেও শোভা পাচ্ছে তাঁর চায়ের ব্যাগের গল্প। গেল বছর মুক্তি পাওয়া ‘দেবী’ সিনেমার পোস্টারও তিনি এঁকেছিলেন। এ ছাড়া লেখক লুত্ফর হাসানের ‘বগি নম্বর জ’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ করা হয়েছে তাঁর টি-ব্যাগ স্টোরি দিয়ে। তিনি টি-ব্যাগ ছাড়াও কাঠ, কাচ ইত্যাদি মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। সাদিত বললেন, ‘কোনো কিছুই ফেলনা নয়, সেটা বুঝেছিলাম ছোটবেলায়ই, যখন আইসক্রিমের বাক্সে ছবি এঁকেছিলাম।’
স্বপ্ন দেশকে তুলে ধরার
টি-ব্যাগে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চান সাদিত। সে কথাই শোনা গেল তাঁর মুখে—‘পরিকল্পনা আছে আরো সুন্দর করে নিজের দেশ ও সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করার। কিছু প্রদর্শনী করারও পরিকল্পনা আছে। স্বপ্ন দেখি এই কাজের মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের কাছে নতুন করে তুলে ধরব।’
ছবি : সংগ্রহ