বাঙালিরা কি পরশ্রীকাতর?
আমরা কি প্রশংসা করতে সব সময়ই একটু কাতর হই? এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে সৈয়দ মুজতবা আলীর নানা গল্পের কথা তো বেশ মনে পড়েই যায়। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলছিলাম। পদ্মা সেতু সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দেখেছি, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ঘটনার পর নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন রাস্তায় যখন বিরাট বিরাট মার্কিন জাতীয় পতাকা একেবারে সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদ থেকে নিচ পর্যন্ত ঝোলানো, সেই সিল্কের পর্দাগুলোর জোগান হয়েছিল চীন থেকে। কেননা তখন এমন প্রয়োজন হয়েছিল জাতীয়তাবোধের তোড়ে যে সেই সিল্ক উৎপাদনের ক্ষমতা তো ছিলই না, উল্টো আমেরিকার মতো দেশ সস্তায় চীনা শ্রমিকদের দিয়ে তাদের নিজের জাতীয় পতাকা তৈরি করেছিল। এ ব্যাপারে বিবিসি একটা অসাধারণ ফিচার স্টোরি করেছিল।
যা হোক, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইব না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, ক্রমেই সমগ্র পৃথিবীর কাছে এটা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে একটা পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরো একবার গোটা দুনিয়ার কাছ থেকে মস্ত বড় সম্মান আদায় করে নিল। আর যাই হোক, কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না।
জল আর স্থল—এই উভয় অংশ মিলেই তো আমাদের পৃথিবী তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর জলভাগ আর স্থলভাগ পুরোপুরিভাবে তো সমসত্ত্বও নয়। পৃথিবীর স্থলভাগ মাত্র ২৯ শতাংশ। জলভাগ ৭১ শতাংশ। তাই মানবজাতি সভ্যতার শুরু থেকেই পরিমাণের দিক থেকে সংখ্যালঘিষ্ঠ স্থলভাগকে নিজের আবাসভূমি বলে মূলত মেনে নিয়েছে। প্রয়োজন হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থার। আর সে যোগাযোগব্যবস্থার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সেতু।
সমাজতান্ত্রিক চীন সেই কবে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর প্রকল্প ঘোষণা করেছিল। এখনো এই উপমহাদেশে আমরা ‘ওয়ান বেল্ট আর ওয়ান রোড’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখছি না। বরং বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী আন্তর্জাতিক দুনিয়ার পরিস্থিতি দেখে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে চীন তাদের এই প্রকল্পের বিষয়ে কিছুটা ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছে। আবার চীন সদর্পে ঘোষণা করেছিল—শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, পাকিস্তান তো আছেই, বাংলাদেশও তাদের এই প্রকল্পে শামিল হয়ে যাবে। ভারতকে তাদের বৈঠকে শামিল হতে বললেও ভারত কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি। কোনো রাজনৈতিক প্রতিনিধি পাঠানো তো দূরের কথা, ভারত কোনো আমলা এবং কোনো প্রশাসনিক কর্তাকেও পাঠায়নি। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত তাদের এই প্রকল্পে কোনো ছাড়পত্র দেয়নি। অনেকে মনে করছেন, পাকিস্তানের মতো পরজীবী রাষ্ট্র এখন শ্রীলঙ্কার আর্থিক বিপর্যয়ের পর এই প্রকল্পে কতটা শামিল হবে, কতটা শামিল হবে না—তা নিয়ে দোটানায় ভুগছে। পাকিস্তান এখন আমেরিকার সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়তে চায়। সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এই অবস্থায় শ্রীলঙ্কার আর্থিক বিপর্যয়ের পর তো অনেকেই চীনের এই প্রকল্পের দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তাদের পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশের মধ্যে বিরাটভাবে যোগাযোগের সেতু গড়ে তুলতে সমর্থ হতে চলেছে। এশিয়ান হাইওয়েতে পদ্মা সেতু হতে চলেছে একটা প্রধান সংযোগ রক্ষাকারী ফ্যাক্টর। যার ফলে সমগ্র এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি এখন এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হবে।
২০০৯ সালে জাতিসংঘের পরামর্শ অনুসারে এশিয়ার ভেতর আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য এই পদ্মা সেতু কাজ করছে। ইউনাইটেড নেশনের পরামর্শ অনুসারে এখন ৩২টি দেশে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তিনটি এশিয়ান হাইওয়ের রুট আছে এশিয়ান হাইওয়ে-১, এশিয়ান হাইওয়ে-২, এশিয়ান হাইওয়ে-১১, যেটা এক হাজার ৭৭১ কিলোমিটার বিস্তৃত হবে। এই এশিয়ান হাইওয়ে-১ সিলেট, ঢাকা, নড়াইল, যশোরের সঙ্গে সংযোগ করবে। পদ্মা ব্রিজ, কালনা ব্রিজ এবং নড়াইলের মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করবে। যেটা ৬৯০ মিটার বিস্তৃত। সেপ্টেম্বর মাসে এর উদ্বোধন হওয়ার কথা। এখানেও কাজটা সোজা নয়।
এ ছাড়া আসছে রেল প্রকল্প। সেই রেল প্রকল্প হলে ভারত, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ উপকৃত হবে। এই ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে ২৮টি দেশের মধ্য দিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুতরাং এটি এক বিরাট প্রকল্প। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে কানাডা আদালতের রায়ের বলে বলীয়ান হয়ে শেখ হাসিনা যে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন, সেটা শুধু এই দেশের তো বটেই, দেশের বাইরেও উপমহাদেশকেও অর্থনৈতিকভাবে এই করোনা আক্রান্ত ইউক্রেনের যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুনরুজ্জীবিত করবে বলে আশা ব্যক্ত করা হচ্ছে।
আসলে এমনটাই হয়। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু হওয়ার আগে উত্তরবঙ্গের মানুষ কখনো কল্পনাই তো করতে পারেনি যে তারা সকালে রওনা দিয়ে দুপুরের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে, আবার বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশে যোগাযোগব্যবস্থাটা ছিল নদীনির্ভর। ধীরে ধীরে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হলো যে সড়কপথে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। বাদ সেধেছিল নদী। একটা সড়ক বানানো হবে, আর পথে নদী পাওয়া যাবে না—এমনটা বাংলাদেশে তো আশা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিল। আজ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য কেমন ভূমিকা পালন করবে বা করতে চলেছে সেটা এখন দেখার বিষয়।
যে ২১টি জেলা পদ্মা সেতুর আওতায় অর্থনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত হবে সেগুলো আমরা সবাই জানি। এই সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে মোংলাবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। আর তার জন্যই বোধ হয় মোংলা বন্দর এলাকায় বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা চালু হয়ে গেছে। ২০৫ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। এই এলাকাটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে, যেটাকে বলে ‘এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন’। আগের অবস্থা থেকে এই এলাকার অনেক উন্নতি হচ্ছে। শুধু পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা অর্থনৈতিক দিক থেকে আকর্ষণীয় বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি তাঁর চট্টগ্রামের কারখানা বিক্রি করে দিয়ে বাগেরহাটে শিল্প গড়েছেন, এমন বক্তব্যও তো গণমাধ্যমে এসেছে। পদ্মা সেতু এই সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
মো. এনায়েত চৌধুরীর লেখা ‘পদ্মা সেতু’ শীর্ষক পুস্তিকা থেকে জানা যাচ্ছে, পদ্মা সেতুর কারণে বিঘাপ্রতি জমির দাম এক লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। এর ফলে জেলায় পর্যটনশিল্পের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আসন্ন উন্নয়ন নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার গতিশীলতা পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। শুধু মোংলা কেন, পায়রা সমুদ্রবন্দরের গুরুত্বও এর ফলে বাড়বে। যে কারণে পায়রাকে এখন গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। সব কাজ শেষ হয়ে গেলে পায়রা সমুদ্রবন্দর, ভুটান, ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশ এবং পূর্ব নেপালের জন্য অনেকটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠবে। খুলনা থেকে রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্পে আয় হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর পণ্য পরিবহনের খরচ কমার পাশাপাশি এই আয় আরো বেড়ে যাবে। সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ থাকায় তিনটি লাভ হবে। দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুবিধা হবে। আর পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। এতে কম খরচে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্য আমদানি করা যাবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. এনায়েত চৌধুরীর ‘পদ্মা সেতু’ শীর্ষক বই থেকে আরেকটি চিত্তাকর্ষক তথ্য জানতে পারলাম। সহজ ভাষায় তিনি বলছেন, ধরা যাক মিয়ানমার থেকে একটা রাস্তা বাংলাদেশে ঢুকবে। বাংলাদেশের রাস্তার অবস্থা খারাপ। মিয়ানমারের রাস্তা খুব ভালো। সেখান থেকে যদি একটা ট্রাক বাংলাদেশের রাস্তায় ঢোকে, তাহলে নানা রকমের সমস্যা হবে। প্রধান সমস্যা হলো, পণ্য পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা, দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ইত্যাদি। একটা অনুন্নত এবং একটা উন্নত রাস্তার গাড়ির চালক উভয়েই একই দক্ষতা নিয়ে যান চালান না। যাঁরা খারাপ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত তাঁদের এ ক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হয় না। কিন্তু হঠাৎ অন্য কোনো দেশের চালক যদি এই রাস্তায় আসেন, তাহলে স্বভাবতই তাঁর কাছে জীবনের এত দিনের পরিচিত গাড়ি চালানোর সমীকরণটা অপরিচিত রাখতে পারে। এই ধরনের ঝামেলা এড়াতে আন্তর্জাতিক সড়ক নেটওয়ার্কের প্রয়োজন হয়, যাতে সব রাস্তায় একই রকমভাবে গুণগত মানের দিক থেকে টেকসই ও সদৃশ হয়।
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক তেমনই একটা আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। ৩২টি দেশ তাদের নিজেদের রাস্তাকে এই এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে রাজি হয়েছে। যার মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, চীন, ইরান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশ আছে। এই বইটিতে এনায়েত চৌধুরী বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের রুটটা নিয়ে বরং অনিশ্চয়তা ছিল। রুটটা সংশোধিতও হয়। শিলংয়ের মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের দিকে পরিবর্তন করা হয়। প্রাথমিক রুট ম্যাপে সমতলভূমির ওপর দিয়ে নকশা করা হয়, যা করিমগঞ্জের ভেতর দিয়ে চলে যায় আসামে। তারপর মণিপুর হয়ে মিয়ানমার। আর একটা রুট ম্যাপ আছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। সমস্যা হচ্ছে, এই রুটটি রাখাইন রাজ্যের ভেতর দিয়ে যায়, যেখানে মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এই কারণে মিয়ানমার সরকার এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে তেমন একটা আগ্রহী হচ্ছে না।
সুতরাং একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, এই এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য এবং ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে তৈরির জন্য আজ সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করে, বিরোধ ও অনৈক্যের জায়গাগুলো দূর করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
এবার ঢাকা সফরে বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর সঙ্গে নৈশভোজের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বিক্রম দোরাইস্বামীও পদ্মা সেতুর এই সাফল্যের কথা উল্লেখ করে বারবার বলছিলেন, পদ্মা সেতুকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশের উন্নয়নের প্রশ্নেও কিন্তু নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ জন্য শেখ হাসিনার সাধুবাদ প্রাপ্য।
লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের
বিশেষ প্রতিনিধি