চীনে শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমিত মারাত্মক ভাইরাস করোনার ঝুঁকিতে বাংলাদেশও রয়েছে। ইতোমধ্যে এ ভাইরাসে চীনে মারা গেছে ৯ জন এবং আক্রান্ত হয়েছে ৪৪০ জনের বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সতর্ক নজর রাখছে। থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে চীনসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আগত বিমানযাত্রীদের পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং তাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন রোগ তত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকে। এর নাম করোনা ভাইরাস হলেও এটা নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস। এখনকার নতুন এই ভাইরাসটির নাম ‘২০১৯ নোবেল করোনা ভাইরাস’ বা ২০১৯এনসিওভি। এর আগে দুইবার করে সার্স ও মার্স নামের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় বিশ্বব্যাপী এবং মারা যায় ৮০০-এর বেশি মানুষ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো নির্দিষ্ট প্রাণী থেকে ভাইরাসটি মানুষের দেহে প্রথমে ঢুকেছে। এরপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে এবং এটা এখনো ছড়িয়ে চলেছে। চীনের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর উহান শহরে সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করে এমন একটি বাজার থেকে এটা প্রথম ছড়িয়েছে। ওই বাজারে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী কেনাবেচা হতো। ‘২০১৯ নোবেল করোনা ভাইরাস’ চীনের উহান শহর থেকে প্রথমে চীনেরই অন্যান্য শহরে ছড়িয়েছে এবং সেখান থেকে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে ছড়িয়েছে। কারণ এসব দেশের সাথে চীনের যোগাযোগ খুবই ভালো। গত মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তির মধ্যে এটি শনাক্ত হয়। তিনি উহার শহরে গিয়েছিলেন।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল রাতে নয়া দিগন্তকে বলেন, ভাইরাসটি যেন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য আমরা বিমান বন্দরেই তাদের পরীক্ষা করছি। থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপ মাপা হচ্ছে। এ ছাড়া করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে এমন দেশে বিশেষ করে চীন থেকে এসেছে এমন যাত্রীদের আইইডিসিআরর কার্ডসহ প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর দিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী ১৪ দিনের মধ্যে কারো জ্বর হলে তারা যেন ওই নম্বরে যোগাযোগ করেন। অধ্যাপক ফ্লোরা আরো জানান, আমরা ইতোমধ্যে হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি যাতে করোনার প্রাদুর্ভাব হলে তারা চিকিৎসা দিতে পারেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এর আগে সোয়াইন ফ্লু বা ইবোলার ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক জরুরি সতর্কতা জারি করা হবে কি না তা নিয়ে গতকালই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিদ্ধান্ত নেবে।
আইইডিসিআর চারটি হটলাইন চালু করেছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দেয়ার জন্য। যদি কারো মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দেয় তারা যেন এসব ফোনে যোগাযোগ করেন। নম্বরগুলো হচ্ছে : ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪ ও ০১৯২৭৭১১৭৮৫।
চীনের ওহোয়ান প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের আক্রমণে ইতোমধ্যে ৯ জন মারা গেছে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের ভাইস মিনিস্টার লি বিন, উহান শহরের ৮৯ লাখ অধিবাসীকে এ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে নিষেধ করেছেন আবার একই সাথে চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো শহর থেকে উহানে ভ্রমণ করতেও নিরুৎসাহিত করেছেন। ইতোমধ্যে উহান থেকে চীনের কয়েকটি শহরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে, দেশটি এই মুহূর্তে ভাইরাসটির প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে। এর আগে চীনা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে, মানুষ থেকে মানুষে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে। ‘২০১৯এনসিওভি’ ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন এটি। বর্তমানে যে ধরনের ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ঠিক এ ধরনের স্ট্রেইন যুক্ত করোনা ভাইরাস এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
নতুন ধরনের এ ভাইরাসটি নিজেই নিজের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করার কৌশল রপ্ত করেছে। ২০১৯ নোবেল করোনা ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেক জনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ঠাণ্ডা-কাশির মতোই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হলে শ্বাস নিতে কষ্ট হবে, জ্বর এবং কাশি হবে। একই সাথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে। হতে পারে নিউমোনিয়া এবং তাতে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
ভাইরাস বলে এর কোনো চিকিৎসা নেই। কারণ কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ভাইরাসকে ধ্বংস করা যায় না। নতুন ধরনের ভাইরাস বলে এখন পর্যন্ত এর কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। এটা বাংলাদেশে যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য বিমানবন্দরে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। তিনি পরামর্শ দেন এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ না হওয়া পর্যন্ত চীনে না যাওয়াটাই উত্তম। গেলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ উহার শহরে যাওয়াই যাবে না।
বাংলাদেশে এখনো ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব না হলেও আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রাদুর্ভাব হলে বাইরে বের হলে মাস্ক (মুখোশ) ব্যবহার করতে হবে। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং নাকে ও মুখে হাত দিয়ে ঘষা যাবে না। প্রাদুর্ভাব হলে বাইরে বের না হওয়াই ভালো হবে। তখন অসুস্থ হলেও মাস্ক পরা উচিত। ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, তবে বাংলাদেশে এখনো উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি, আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই।
‘২০১৯এনসিওভি’ যেভাবে ছড়িয়েছে : ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানিয়েছে, চীনের উহান শহরে নিউমোনিয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ১ জানুয়ারি সামুদ্রিক মাছ কেনাবেচার বাজারে কোনো এক অজানা প্রাণী থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে প্রথম বিশ্বাস করা হয়। ৯ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, সংক্রমণটি নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস থেকে হয়েছে। ১১ জানুয়ারি প্রথম ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে এ ভাইরাসে। ১৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসটি। ১৬ জানুয়ারি জাপানে শনাক্ত হয় করোনা ভাইরাস। ১৭ জানুয়ারি উহানে ৬৯ বছর বয়স্ক একজন মারা যায়। ২০ জানুয়ারি আক্রান্ত তিন গুণের বেশি ২০০ পর্যন্ত পৌঁছে। চীনা রাজধানী বেইজিংয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসটি। এ ছাড়া শেনঝেন ও সাংহাইয়েও ছড়ায় একই দিন। চীনা কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, এটা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। ২১ জানুয়ারি উত্তর আমেরিকা মহাদেশে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। ২২ জানুয়ারি ৯ জন মারা গেছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪০০-এর বেশি।