ধলেশ্বরী পিলার নম্বর-৩১৩। পিলারের এ পরিচিতিটুকুই বলে দিচ্ছে- জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়। এ পিলারের উত্তর পাশে নদীর বুকজুড়ে একাধিক সাইনবোর্ড মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটিতে অভিন্ন একটি বাক্য জ্বল জ্বল করছে ‘ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক মো. সুজাত মোস্তফা।’ কে এই সুজাত মোস্তফা? তিনি অ্যাপোলো হাউজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে এ হাউজিংয়ের প্রকল্প হিসেবে। প্রকল্প এলাকায় দুই রুমের একটি অফিস। দীর্ঘদিন সেই অফিস খোলা হয় না; তালায় মরচে পড়ে গেছে। প্রকল্পের জমিজুড়ে ঘন বন। নদীর স্রোতে ভেঙে পড়েছে অনেক প্লটের মার্কিং ওয়াল।
নদীর এ জায়গা নিজের ক্রয়কৃত ঘোষণা দিয়ে দেদারসে বিক্রি করেছেন অ্যাপোলো হাউজিংয়ের এমডি সুজাত মোস্তফা। সরকারের চিহ্নিত পিলারের ভেতরেই বড় বড় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন তিনি ক্রয়সূত্রে এসব জমির মালিক, তা জানান দিতে। নদীর ভেতর সাইনবোর্ড দেওয়া প্রসঙ্গে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এনশিওর হাউজিং ৭০-৮০ বিঘা জায়গা ভরাট করেছে সেই তুলনায় আমি ছোট।
নদী ভরাট করে প্লট আকারে এ জমি তিনি বিক্রি করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। প্রায় ৮-৯ বছর হলেও কোনো প্লট বুঝিয়ে দিতে পারেননি ক্রেতাদের কাউকে। অনেক ক্রেতাই এখন বুঝতে পারছেন যে, তারা ভুল করেছেন। সর্বস্বান্ত হয়ে কেউ কেউ কান্নাকাটিও করছেন অফিসে এসে, ধর্ণা দিচ্ছেন টাকা ফেরত পেতে। তবে হাউজিং কর্তৃপক্ষের ভাষ্য এ মুহূর্তে তাদের কিছুই করার নেই। চূড়ান্ত সমাধান না আসা পর্যন্ত কারও টাকা দিতে তারা অপারগ।
জায়গাটি সম্পর্কে সরকারি নথিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে ঢাকা জেলা অন্তর্গত কেরানীগঞ্জ উপজেলাধীন রাজস্ব সার্কেলের (দক্ষিণ) আওতাভুক্ত চরবাক্তা মৌজার সূত্রোস্থ স্মারকে উল্লিখিত সমুদয় সম্পত্তি সিএস নকশা অনুযায়ী ধলেশ্বরী নদী। পরে পেটি জরিপে ওই ধলেশ্বরী নদীর আংশিক নদীর ভূমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ডভুক্ত হয়, যা এসএ রেকর্ড হিসাবে বিদ্যমান। সর্বশেষ আরএস রেকর্ডে ঢাকা জেলার অন্তর্গত ধলেশ্বরী নদীর আংশিক ভূমি, যা বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানায় আরএস রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় ওই ভূমির রেকর্ড এসএ/আরএস রেকর্ড সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এতদাসঙ্গে প্রেরণ করা হলো।
২০২২ সালের ২৩ জুন জেলা প্রশাসক ঢাকার পক্ষ থেকে এমন একটি চিঠি (স্মারক নম্বর ০৫.৪১.২৬০০.০২০.৫২.৪৬৫.২২-৬৯৮) মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠানো হয়। চিঠির বিষয়টি স্বীকার করে সিরাজদিখান উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাসনিম আক্তার আমাদের সময়কে বলেন, ‘খাসজমি না। ওটা হচ্ছে সিকস্থি। এর মানে আগে নদী ছিল। ওটা ধলেশ্বরী নদী ছিল। আর এসএ জরিপে ব্যক্তিমালিকানাধীন নাম আছে। কিন্তু সিএস ও এসএ জরিপ অনুযায়ী নদীই আছে।’
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে ভূমির বাস্তব অবস্থা জানতে চেয়ে চিঠি দেয় ও প্রতিবেদন দিতে বলে। আমরা দাগ নম্বর উল্লেখ করে চিহ্নিত করে দিয়েছি কোন কোন দাগ সিকস্থিতে পড়েছে। তখন ডিসি স্যার এবং পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই জমির যেন সব ধরনের ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর, খাজনা আদায় সব কিছু বন্ধ থাকে। নির্দেশ মোতাবেক সেভাবেই কাজ করছি। প্রায় দুই মাস আগে নায়েব অফিসসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। সাব-রেজিস্ট্রির অফিসকেও বলা হয়েছে। অ্যাপোলো হাউজিং থেকে গত মাসে খাজনা দিতে গিয়েছিল। তাদের কাছ থেকে খাজনা নেওয়া হয়নি। কাজেই এখন আর নতুন দলিল হচ্ছে না।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সিরাজদিখান ভূমি অফিস থেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়। সেই নোটিশের বিষয় ছিল অ্যাপোলো হাউজিং লিমিটেড কর্তৃক ভরাটকৃত জমির আরএস রেকর্ড সংশোধনের লক্ষ্যে তথ্য প্রেরণ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সিরাজদিখান উপজেলাধীন বালুচর ইউনিয়নের অন্তর্গত অ্যাপোলো হাউজিং লিমিটেড নামক একটি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। ওই হাউজিংটি চরপানিয়া মৌজার আরএস রেকর্ডের ২০৪, ৫৫, ৩০১, ২০৪, ২৫৫, ৩২৫, ২৮১, ৩১৯, ও ৩২৩ নং খতিয়ানভুক্ত ৭৯৭, ৮০০, ৮০২, ৮০৩, ৮০৪, ৮০৫, ৮০৬, ৮০৭, ৮০৮, ৮১২, ৮১৩ দাগের ভূমিতে অবস্থিত, যা এসএ ও আরএস রেকর্ডে মালিকানাধীন সম্পত্তি হলেও সিএস রেকর্ডে ধলেশ^রী নদী হিসেবে বিদ্যমান ছিল। যেহেতু সিএস রেকর্ডে ওই ভূমি নদী শ্রেণি হিসেবে ছিল, সেহেতু বর্ণিত দাগের ভূমি নদী হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করার নিমিত্ত এসএ ও আরএস রেকর্ড সংশোধনের জন্য আদালতে মামলার লক্ষ্যে বিজ্ঞ সহকারী কৌঁসুলিকে পত্র দেওয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে অ্যাপোলো হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সুজাত মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, ‘চিঠি একটা এসেছে। তবে নদীর জায়গা; এটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না। চিঠিতে রেকর্ড সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। জায়গাটা আমাদের কেনা। আমাদের পাশে আরও হাউজিং আছে। এনশিওর হাউজিং তাদেরটা আর আমাদেরটা কাগজপত্র অনুযায়ী একই জমি। এনশিওর তো প্রায় ৭০-৮০ বিঘা ভরাট করেছে। সেই তুলনায় আমি খুবই ছোট।’
অন্যদিকে অ্যাপোলো হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, অ্যাপোলো হাউজিং আমাদের। হাউজিং যেহেতু করেছি। হাউজিং করলে তো কিছু বিক্রি হয়। বিক্রি করেছি। নদী-মোদি তো আমরা বুঝি না। আমাদের জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে। জমি রেজিস্ট্রি দিয়েছি। আমরা তো জানি না কী হয়েছে। হাউজিংয়ের কার্যক্রম চলমান। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাইনি। সরকার কী করবে, তা সরকারের লোকেরাই ভালো বলতে পারবে। মৌখিকভাবে (ভার্বালি) এসিল্যান্ড অফিস থেকে নিষেধ করেছে। সেই নির্দেশনা তো মানতেই হবে। তিনি বলেন, ১২-১৩ বিঘা নিয়ে আমাদের হাউজিং। সেখানে ৮-৯ বছর ধরে বেচাকেনা হচ্ছে। আমাদের ডানে-বাঁয়ে আরও হাউজিং আছে। তাদের বিষয়ে তো এমন কিছু শোনা যায় না। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে হয়তো এটি করাচ্ছে। আমরা এক মাস আগে মৌখিকভাবে জেনেছি। জানার পর জিএম সাহেবকে পাঠিয়েছিলাম ভূমি অফিসে বিষয়টি জানার জন্য। এখনো চূড়ান্ত কিছু জানতে পারিনি।
এটি ধলেশ্বরী নদীর জায়গা এ তথ্য তো আপনার জানার কথা? নদীর জায়গা কীভাবে বিক্রি করলেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা এখানে স্থায়ী না। আমরা জানব ক্যামনে! এর পরই প্রশ্ন করা হয়Ñ আপনাদের প্লট কিনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ক্ষতি কীভাবে সামাল দেবেন? এর উত্তরে অ্যাপোলোর চেয়ারম্যান বলেন, ‘এ মুহূর্তে তো করার কিছু নেই।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল আমাদের সময়কে বলেন, প্রথমত নদীর জায়গা কোনোভাবে কোনো কারণে কোনো পদ্ধতিতেই কাউকে দেওয়া যায় না। এটা রাষ্ট্রের সম্পত্তি। সরকারও এটা ব্যবহার করতে পারে না। সরকার যদি ব্যবহারের জন্য অথরিটি মনে করে, তা হলে সেটি হবে ভুল সিদ্ধান্ত। কোনো প্রোপার্টিকে দেওয়া পরের কথা। নদীর জায়গা নদীকেই দিতে হয়। সিকস্থির জায়গা হলে আইন অনুযায়ী নদীর জায়গা হিসেবেই গণ্য হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা সেলিম শেখ আমাদের সময়কে বলেন, অ্যাপোলো হাউজিং রাতারাতি নদী ভরাট করে প্লট ব্যবসা শুরু করেছে। অ্যাপোলো হাউজিংয়ের কাছ থেকে জমি কিনে অনেকেই সর্বস্বান্ত। এখন প্রতিদিন লোকজন এসে হাউজিং কোম্পানিকে ধরার চেষ্টা করছে; কিন্তু তাদের দেখা মিলছে না। নদীর জায়গা বিক্রি করেই শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন অ্যাপোলোর এমডি।