ধর্ষণের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। আগে ধর্ষণের কোনো ঘটনা জানাজানি হলেই এর বিরুদ্ধে সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতো। অপরাধীরা নিন্দা ও ঘৃণার বাণে বিদ্ধ হতো। ফলে ধর্ষকরা সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে যেত। বিচারের মাধ্যমে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি না হলেও তীব্র সামাজিক চাপ মোকাবেলা করা একজন ধর্ষকের জন্য কঠিন হতো। এখন ধর্ষণের ঘটনা একটি মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ হলেও এখন প্রতিবাদে-ক্ষোভে মানুষ আর ফুঁসে উঠছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন রূপান্তরের হেতু বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাষ্ট্র যখন ধর্ষণকে গুরুতর বিবেচনা করে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়; গণমানুষের ঘৃণা-ক্ষোভ প্রকাশের শক্তি তখন কমতে থাকে। ফলে ধর্ষণের বিস্তৃতি দিন দিন বাড়ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে শিশু, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের ধর্ষণসহ নানা বিকৃতি ও অনাচার।
এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম মাসে ধর্ষণ বাড়ার হারে রেকর্ড গড়েছে। গত বছরের প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে এ সময়ে ২১১ নারী ও শিশু ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) সেন্টারে ভর্তি হয়েছে। এটি সাধারণ ব্যাপার, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধামাচাপা দেয়া হয়। কেউ লজ্জায় এবং নিজের ভবিষ্যতের শঙ্কায় দুর্ঘটনাটি আড়াল করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপে এ ধরনের ঘটনার কবর রচনা হয়। তাই খুব অল্প ভুক্তভোগী ওসিসিতে আসে বা আসতে পারে। বরাবরের মতো প্রতি বছরই এখন আগের বছরের চেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায় যা ৯৩ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩২৭টি। মানুষ ক্রমেই দলগতভাবে পাশবিক আচরণ চরিতার্থ করার প্রতি প্রলুব্ধ হচ্ছে। এ জন্য বিদেশী সংস্কৃতির কুপ্রভাব কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আর ধর্ষণপরবর্তী হত্যার ঘটনাও বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের দুর্বল পেয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে।
৭ বছরে ওসিসিতে আসা চার হাজার ৫৪১টি মামলার মধ্যে ৬০টি ঘটনার শাস্তি হয়েছে। ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে প্রায় পাঁচ হাজার মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধান করেছে ঢাকার একটি দৈনিক। এতে দেখা গেছে, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর তিন শতাংশের সাজা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিচারের অবস্থা কতটা সঙ্গিন। আমাদের দেশের ধর্ষকদের কেন এই বাড়বাড়ন্ত তা-ও বোঝা যায়। মূলত ধর্ষকরা এ গুরুতর অপরাধ করে আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের মামলা পরিচালনা করতে ভুক্তভোগী পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। ধর্ষণের মামলায় নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজিরা দেয়ার মাধ্যমে তারা যেন একটা কলঙ্ক বয়ে বেড়ান। মামলা চালানোর ক্ষেত্রে মানসিকভাবে তাদের চাপে থাকতে হয়। এর ওপর অর্থ খরচের ভার অনেকে বহন করতে পারেন না। উপরন্তু রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের চাপ।
ধর্ষণ নিয়ে সামাজিক পর্যায়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কমে যাওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থার দায় অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার রাষ্ট্রের কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। বিচারের প্রক্রিয়ায় তাদের প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ, সেটিও অপ্রতুল। ফলে ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু ও তার পরিবার হেয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। একের পর এক ধর্ষণ ঘটতে থাকা আর বিচার না হওয়ায় মানুষজনও এ ঘৃণিত কর্মকে নিজেদের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে দেখেন। সে জন্য ধর্ষণকে এখন সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। উপযুক্ত বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার গরজ তারা অন্তর্গতভাবে আর অনুভব করছেন না। ফলে আমাদের সমাজ ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন বিবেকবান মানুষের সর্বশক্তি দিয়ে ফের জেগে ওঠা।