ডলার সঙ্কটে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হয় ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে থাকে। রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় ডলার বিক্রি এখন সরকারি বিশেষ কেনাকাটার মধ্যে সীমিত করা হয়েছে। এর পরেও গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রিতে দর এক টাকা বাড়িয়ে ১০৩ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ দরেই গতকাল ৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগের দিন যা ছিল ১০২ টাকা। এ দিকে রেমিট্যান্স বাড়লেও রফতানি আয় কমে যাচ্ছে। এতে ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। আর এ কারণেই গতকাল আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম এক টাকা বাড়িয়ে ১০৪ টাকা থেকে ১০৫ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। এক দিকে ডলারের দাম বাড়ছে, সামনে খড়গ ঝুলছে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। সবমিলেই পণ্য আমদানিব্যয়সহ ব্যবসায় ব্যয় বেড়ে যাবে আর এতে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, পোশাক রফতানি আয়ের অর্ডার নিম্ন গতিতে রয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে গত মার্চের রফতানি আয়ের ওপর। গত মার্চে রফতানি আয় হয়েছে ৪৬৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, যেখানে আগের বছরের মার্চে রফতানি আয় হয়েছিল ৪৭৬ কোটি ২২ লাখ মার্কিন ডলার। সামনে এ রফতানি আয় আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে রফতানি খাতের কাঁচামালের এলসি খোলা কমেছে ৩৪ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। রফতানির আদেশ কমায় কাঁচামালের আমদানি ও এলসি খোলা দুটোই কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আগামীতে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রমজান ও সামনে ঈদকে কেন্দ্র করে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা দেশে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আর এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ গত মার্চে বেড়ে ২০২ কোটি ডলার হয়েছে। কিন্তু দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ আসে রফতানি আয়ের মাধ্যমে। আর ২৮ শতাংশ আসে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। বাকি ২ শতাংশ আসে অন্যান্য খাতের মাধ্যমে। তাই রফতানি আয় কমে যাওয়ায় ডলারের আন্তঃপ্রবাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাফেদা রেমিট্যান্স আহরণের জন্য দর নির্ধারণ করে দিয়েছে ১০৭ টাকা প্রতি ডলার। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাংক ১০৩/১১৪ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। আর আমদানিকারকের কাছে বিক্রি করছে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা পর্যন্ত দরে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন ১২টি ব্যাংককে চিহ্নিত করেছে। ব্যাংকগুলোকে এরই মধ্যে তদারকির আওতায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাফেদার নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দর পরিশোধ করতে কোনো মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি করা হচ্ছে। দোষী প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঘোষণার চেয়ে বাড়তি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করায় কিছু ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আগে ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন শুধু সরকারি বিশেষ কেনাকাটায় সহযোগিতা করতে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এতে বাজারে বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রচণ্ড চাপে পড়ে গেছে। গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। ডলার সংস্থান করতে না পারায় অনেক ভালো গ্রাহক এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। গ্রাহক ধরে রাখতেই মূলত বাড়তি দামে কিছু ডলার আহরণ করা হচ্ছে।
এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগের মতো সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে না। শুধু সরকারি কেনাকাটায় সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারের দাম ১ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ দরেই গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এ সুবাদে চলতি অর্থবছরের গতকাল পর্যন্ত প্রায় পৌনে ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গতকাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩১.২ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসেবে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে রিজার্ভ হয় ২৩ বিলিয়ন ডলার। এ ৮ বিলিয়ন ডলার রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল আকারে ইতোমধ্যে ব্যয় করা হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ চাপে পড়ে গেছে। আর এ কারণেই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বাফেদা। ব্যাংকগুলো সঙ্কটে পড়লে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ডলার কেনার মাধ্যম এ আন্তঃব্যাংকে গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলারের জন্য যেখানে ব্যয় করা হতো ১০৪ টাকা, গতকাল তা ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে ঘোষণার চেয়ে বেশি দরে ডলার না কিনতে ব্যাংকগুলোকে আবারো অনুরোধ জানিয়েছে বাফেদা। গত রোববার বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম এবং ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ এবিবি চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ অনুরোধ করা হয়েছে। তবে রেমিট্যান্সে ১০৭ টাকা অপরিবর্তিত থাকবে। আর রেমিট্যান্স ও রফতানি বিল নগদায়নের সাথে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করা হবে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক দিকে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম বাড়ছে, কমছে রফতানি আয়, অপর দিকে সামনে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলেই ব্যবসায় ব্যয় আরো বেড়ে যাবে বলে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। আর এর প্রভাবে পণ্যের দাম আরো যাবে। এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।