নেই কোনো অহঙ্কার। ভুলে যাননি অতীতের সেই কষ্টের জীবনকে। চলনে বলনে একেবারেই সাধারণ মানুষ। পোশাকও জানান দেবে না তার বর্তমান অবস্থান। প্রবাসী অন্য আট-দশ বাংলাদেশীর মতোই আচার আচরণ। অথচ মাঝারি গড়নের এই ব্যক্তিটিই মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশীদের গর্ব। দেশের অহঙ্কার। অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই ব্যক্তিটি এখন কোটিপতি। তার বাবা ছিলেন রিকশাচালক। এখন মালদ্বীপ প্রবাসী ব্যক্তিটির অধীনে চাকরি করছেন ১৮-২০ জন কর্মচারী। এই ব্যক্তিটির নাম হাদিউল ইসলাম। মালদ্বীপের ফোর এল ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার তিনি। তার উদ্যোগে প্রতি বছর মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে অনুষ্ঠিত হয় ইফতারের আয়োজন। যে ইফতারি অনুষ্ঠানে অংশ নেন শত শত প্রবাসী বাংলাদেশী।
‘মালদ্বীপে চাকরি করা সাধারণ বাংলাদেশী শ্রমিকের পক্ষে ভালোভাবে ইফতারি করা সম্ভব নয়। তাই আমি প্রতি বছর একবার করে তাদের ইফতারি করাই। আমার এই এক দিনের আয়োজনটা পর্যাপ্ত নয়। এরপরও সামান্য এই প্রয়াস। প্রতিদিনতো আর করানো সম্ভব নয়।’ জানালেন হাদিউল ইসলাম।
কিশোরগঞ্জ সদরে রিকশা চালাতেন হাদিউলের বাবা। আদি এই পরিচয় প্রকাশ করতে কোনো কুণ্ঠাবোধ হলো না হাদিউলের। বরং গর্বিত সেই অবস্থা থেকে উঠে এসে এখন ভালো অবস্থানে থাকা। জানান, আমি আজ থেকে ১৭ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে আসি। আমার রিকশাচালক বাবা তার অন্যান্য সম্পত্তির সাথে জমি বিক্রি করে বহু কষ্টে আমাকে মালদ্বীপে পাঠানোর জন্য এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জোগাড় করে দেন। আমার কাছে মালদ্বীপ আসাটা ছিল স্বপ্নের মতো। মালদ্বীপে আসার পর আমার কাজ ছিল একটি বাসায় গৃহভৃত্যের। একজন চাকর বাড়িতে যে যে কাজ করে থাকে আমি এই সবই করেছি। তখন তার বেতন ছিল মাসে একশত ডলার। মালদ্বীপের মুদ্রায় ১২৮৫ রুপিয়া। হাদিউল জানান, এত অল্প টাকা বেতন হওয়ায় আমি তিন মাস বাসা থেকে বের হয়ে কোনো দিন দোকানে চা পর্যন্ত পান করিনি। তিন বছর পর যখন দেশে ছুটিতে যাই তখনই একটি শার্ট কিনেছি। এর আগে কোনো শার্টও কেনা সম্ভব ছিল না। এরপরই যে বাড়িতে কাজ করতেন সেই বাড়ির মালিকের ভূয়সী প্রশংসা হাদিউলের। আমার মালিক খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার সাথে মিলেই আমি শুরু করি সেদ্ধ করে হালকা পোড়ানো পলিথিন মোড়ানো টুনা মাছ বিক্রি। মালদ্বীপে যা টুনা চিপস নামে পরিচিত। কারণ মালদ্বীপের মানুষ এই টুনা মাছ খুব পছন্দ করেন। এতে লাভ হতে থাকে আমাদের। তখন মালিক আমাকে মাসে ১০০ রুপিয়া দিতেন। আমি সেখান থেকে ৫০ রুপিয়া জমিয়ে রাখতাম। তথ্য দেন, ‘আমি ছিলাম বাবার বড় ছেলে। আমার ছোট দুই ভাই ও দুই বোন। তাদের দেখতে হবে। তাই খুব হিসাব করে চলতে হয়েছে। এরপর মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতে এবং বাংলাদেশীদের সহযোগিতায় আজ আমি এই অবস্থানে।’
এক পর্যায়ে তার মালিক হাদিউলের ওপরই এই ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপরই ঘুরে দাঁড়ানো শুরু বাংলাদেশী এই প্রবাসীর। এর কিছু দিন পর দুনিয়া ছেড়ে চলে যান সেই মালিক। কিন্তু হাদিউল ভুলতে পারেননি সেই দিভেহিকে (মালদ্বীপের জনগণকে দিভেহি নামে ডাকা হয়)। সেই মালিকের চারটি মেয়ে ছিল। প্রত্যেকের নামের আদ্যাক্ষর ছিল এল দিয়ে। তাই হাদিউলের কোম্পানির নামও রাখা হয় ফোর এল ইন্টারন্যাশনাল নামে। জানান, ফোর এল মানে তাদের চারজনের নামের প্রথম অক্ষর। অন্যভাবে বললে, ফোর এল মানে চার লেডি। এই হিসেবেই আমার কোম্পানির নাম ফোর এল। তাদের নামেই কোম্পানিটি উৎসর্গ করা।
ধূমায়িত টুনা মাছ বিক্রি আরো আগেই ছেড়ে দিয়েছেন হাদিউল। কারণ এই ব্যবসায় প্রতিদ্বন্দ্বী বেড়ে গেছে। ২০১৬ সাল থেকে তিনি চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে খাদ্যদ্রব্য মালদ্বীপে আমদানি শুরু করেন। হাঁস, মাছ, গরুর গোশত, ডাল, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি তার আমদানি পণ্য। এ সবই তার মালদ্বীপ প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য। যাতে তারা সস্তায় কিনতে পারেন তাদের এই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। বাংলাদেশী এই ব্যবসায়ী যোগ করলেন, আমি এই প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্যই বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানি করি যাতে তারা কম মূল্যে কিনতে পারে। তার দেয়া তথ্য, আমি বাংলাদেশ থেকে বেঙ্গল মিটের গরুর গোশত আমদানি করতে পারি না। কারণ এতে মালদ্বীপে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য এর দাম পড়তো কেজিপ্রতি এক হাজার টাকা। প্রবাসীদের জন্য এটা ছিল ব্যয়বহুল। তাই আমি পাকিস্তান থেকে আরো কম দামে গোশত আমদানি করা শুরু করি। এখন বাংলাদেশ থেকে অলিম্পিক কোম্পানির পণ্য আমদানি করছেন। তিনি তথ্য দেন, মিয়ানমার থেকে আগে মাছ আমদানি করতাম। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুর পর কেউ আর মেইড ইন মিয়ানমার পণ্য কিনতো না। তাই মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করেছি।
প্রবাসে থাকা দেশের জনগণের জন্য কিছু করতে পেরে গর্বিত হাদিউল। জানান, আমার খুব ভালো লাগে যখন জনগণ বলে আমার আনা পণ্য তারা কম মূল্যে কিনতে পারছে। মাঝে মধ্যে আমাকে না চিনেই তারা আমার সামনে বলতে থাকে হাদিউল ভাইয়ের কারণে আমরা সস্তায় পণ্য পাচ্ছি।
প্রতি বছরই মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে আয়োজিত হয় হাদিউলের আয়োজনে ইফতার। এতে তার ব্যয় হয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো। আর যে হলে এই ইফতার হয় সেখানে ভাড়া লাগে ৪০-৫০ টাকার মতো। তবে হাদিউলের কাছে থেকে হল ভাড়া নেন না হলের মালিক। ১৭ বছরের মালদ্বীপ জীবনে এ পর্যন্ত ১৫ বার প্রবাসীদের ইফতার করিয়েছেন তিনি। দু’বার করাতে পারেননি। একবার দেশে ছিলেন। অন্যবার করোনার জন্য।
বাবা-মাকে ভুলে যাননি হাদিউল। বাবা ও মাকে ওমরাহ হজ করিয়ে এনেছেন। এখন তাদের মালদ্বীপে ভ্রমণ করতে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। বাবা এখন কিশোরগঞ্জের স্থানীয় এক মসজিদের সভাপতি। তিনি বাবাকে বলেছেন, ‘জুতা আর আপনি পা থেকে খুলতে পারবেন না।’ মানে আপনার আর রিকশা চালানোর কোনো সুযোগই নেই।
মালদ্বীপের অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী মালদ্বীপের মেয়ে বিয়ে করেছেন। তবে হাদিউল বিয়ে করেছেন বাংলাদেশেই। তার দুই সন্তান। স্ত্রী-সন্তানরা মালদ্বীপ-বাংলাদেশ যাওয়া আসার মধ্যে থাকেন। হাজার দ্বীপের দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাসী হলেও তার ইচ্ছে বাংলাদেশে ফিরে এসে এখানেই স্থায়ী হওয়া। সে সাথে অন্য লোকের মাধ্যমে মালদ্বীপেও ব্যবসায় চালিয়ে রাখা। তার এবারের ইফতারের আয়োজনের স্লোগান ছিল ‘আসফি ইজ দ্য বেস্ট ফ্রেন্ড।’ আসফি নামে নতুন এক কোম্পানি খুলেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশে বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তিনি।