দিবস-রজনী, মাস-বছর সবই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। তারপরও এসবের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। বিশেষ করে লাইলাতুল কদর অনন্য ও অনুপম মর্যাদার অধিকারী। এ রাত প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পৃথক একটি সূরা নাজিল করেন। ‘অবশ্যই আমি একে (কুরআনকে) কদরের রজনীতে নাজিল করেছি। (হে রাসূল সা:) আপনি কি জানেন, কদরের রজনী কী? কদরের রজনী হচ্ছে এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে যাবতীয় কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রূহ (হজরত জিবরাইল আ:) অবতীর্ণ হন তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে। এটি শান্তির রজনী বলে ঘোষণা করেন। এ রজনীর বরকত ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সূরা আল কদর)
লাইলাতুল কদর অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী। এ রাতকে লাইলাতুল কদর নামকরণের অনেক কারণ রয়েছে। ইমাম জুহুরি রহ: বলেন, এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলার অর্থ হলো- এ রাত অতীব মূল্যবান, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। শেখ আবু বকর ওয়াররাক বলেন, এ রজনীতে ইবাদতের মাধ্যমে এমন অনেক লোক মান-সম্মান অর্জন করেন, যাদের ইতঃপূর্বে কোনো মান-সম্মান ছিল না। কদরের আরেক অর্থ তাকদির বা ভাগ্য নির্ধারণ। এ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করেন, যাতে সব মানুষের জন্ম, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির তারিখ ও পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকে। এমনকি এ বছর কে কে হজ করবে তাও লিখে দেয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস রা:-এর মতে, যে চারজন ফেরেশতাকে এসব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয় তারা হলেন- হজরত জিবরাইল আ:, হজরত মিকাইল আ:, হজরত ইসরাফিল আ: ও হজরত আজরাইল আ:।’ (কুরতুবি)
অনুপম রজনী : লাইলাতুল কদর এক অনুপম ও তুলনাহীন রজনী। এ রাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ পবিত্র কুরআন মাজিদ সর্বপ্রথম এ রাতেই নাজিল হয়। ফলে এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের (৮৩ বছর চার মাসের) ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে জিবরাইল আ: ফেরেশতাদের এক বিরাট জামাত নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন। হজরত আব্দুল কাদের জিলানি রহ: তার বিখ্যাত গ্রন্থ গুনিয়াতুত তালেবিনে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে এ ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
হজরত শাহ আবদুল আজিজ রহ: বলেন, এ রাতে বিপুলসংখ্যক ফেরেশতা পৃথিবীতে পাঠিয়ে আদম সন্তানের ইবাদত গুজারির সেই অনুপম দৃশ্য দেখানো হয়। যখন তারা আল্লাহর ইবাদত তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদিতে রত থাকে। যেমন ফেরেশতারা বলেছিলেন, আপনি কি পৃথিবীতে এমন জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে? এ রাতে সেই আশঙ্কার উত্তর ফেরেশতারা পেয়ে যান।
লাইলাতুল কদর কখন : হজরত উবাদা ইবনে সামিত রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বর্ণনা করেন, একদা মহানবী সা: তাঁর কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাদেরকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বর্ণনা দেয়ার উদ্দেশ্যে বের হন, তখন দু’জন সাহাবি একটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছিল। তিনি পৌঁছেই বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবহিত করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়া করার কারণে নির্দিষ্ট তারিখ আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা রমজানের শেষ দশকের নবম, সপ্তম, পঞ্চম রাতে তা খোঁজ করো।’ (সহিহ বুখারি) হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- মহানবী সা: বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোয় লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (সহিহ বুখারি) সহিহ মুসলিম শরিফে হজরত উবাই ইবনে কাব রা: থেকে বর্ণিত- লাইলাতুল কদর হচ্ছে ২৭ রমজানের রাত। ইমাম আবু হানিফা রহ: ও অন্যান্য ইমাম লাইলাতুল কদর ২৭ রমজানের রাতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
লাইলাতুল কদর বিশেষ উপহার : লাইলাতুল কদর শেষ নবীর উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার এবং মহান নিয়ামত। ইমাম মালেক রহ: মুয়াত্তায় বর্ণনা করেছেন, মহানবী সা: জানতে পারলেন, আগেকার উম্মতের বয়স অনেক দীর্ঘ হতো, সে তুলনায় নিজের উম্মতের বয়স অনেক কম। সুতরাং তার উম্মতের আমলের পরিমাণ এ হায়াতের ব্যবধানে আগেকার উম্মতের আমলের পরিমাণের সমান হবে না। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়ে প্রিয়নবী সা: মর্মাহত হন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর উম্মতকে লাইলাতুল কদর প্রদান করেন, যাতে এ ব্যবধান দূরীভূত হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবায়ে কিরামের সামনে বনি ইসরাঈলের এক আবিদ ব্যক্তির কথা বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় বিরামহীনভাবে এক হাজার মাস জিহাদ করেছেন। মহানবী সা:-এর এ বর্ণনা শুনে সাহাবায়ে কিরাম সে লোকটির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ তায়ালা এ দীর্ঘ সময়ের বিকল্প হিসেবে উম্মতে মুহাম্মাদিকে লাইলাতুল কদর প্রদান করেন।
কদরের রাত চেনার উপায় : এই রাত্রি চেনার উপায় হলো- ১. এ রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না; ২. এ রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে; ৩. এ রাতে প্রবাহিত হবে মৃদু-মন্দ বাতাস; ৪. এ রাতে ইবাদত করে মানুষ বেশি পরিতৃপ্ত হবে; ৫. এ রাতে ও সকালে হালকা বৃষ্টি হবে; ৬. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। (সহিহ বুখারি-২০২১, মুসলিম)
কদর রাতের ইবাদত : মহানবী সা: মাহে রমজানের প্রথম ২০ রজনী পূর্ণ রজনী জাগ্রত থাকতেন না। কিছু সময় ইবাদত করতেন এবং কিছু সময় নিদ্রা যেতেন। কিন্তু রমজানের শেষ ১০ রাতে তিনি বিছানায় যেতেন না। সব রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন। তিনি কুরআন তিলাওয়াত, সালাত আদায়, সদকা প্রদান, জিকির-আজকার, দোয়া, তাসবিহ-তাহলিল ও কান্নাকাটি করতেন। তিনি নিজে যেমন অনিদ্রায় রাত কাটাতেন তেমনি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকেও রাতে জাগিয়ে দিতেন। কদর রাতের ফজিলত লাভ করার জন্য তিনি শেষ ১০ দিনের পুরো সময়টিতে ইতেকাফে রত থাকতেন। (মুসলিম-১১৬৫)
প্রিয় নবী সা:-এর অনুসরণে এ রাতটি কুরআন তিলাওয়াত, নফল সালাত, জিকির-আজকার, ইস্তিগফার, তাসবিহ-তাহলিল ও দোয়া মুনাজাতে কাটিয়ে দেয়া উচিত। হজরত আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল। আমি যদি কোনোক্রমে অনুধাবন করতে পারি যে, আজই লাইলাতুল কদর, তাহলে আমি এ রাত্রে কী দোয়া পড়ব? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তুমি এ দোয়া পড়বে- আল্লাহুমা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিববুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’। হে আল্লাহ তুমি পরম ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমাকে পছন্দ করো, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিজি-৩৫১৩) আল্লামা আলুসি রহ: বলেছেন, কদরের রাত্রে সবধরনের ইবাদত করা উচিত। যেমন- নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, তাজবিহ-তাহলিল, ক্ষমা প্রার্থনা, দোয়া ইত্যাদি।
লেখক :
প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী