রমজান আসতে এখনো প্রায় দুই মাস বাকি। এরই মধ্যে হু হু করে বাড়ছে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মাছ, মুরগি, দুধ, ডিম, খেজুরসহ সব কিছুরই দাম বাড়তি। দেশব্যাপী চলমান নীরব মন্দাবস্থায় এমনিতেই মানুষের হাতে টাকা নেই।
সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভর করে যারা সংসার চালান, সুদহার অর্ধেকে নামিয়ে আনায় চোখে এখন অন্ধকার দেখছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে মধ্যবিত্তের এখন চিঁড়েচ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থা।
বাজারদর পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবেই গত এক সপ্তাহে অন্তত এক ডজন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এক কেজি তিতা করলা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। নগরীর গ্রাহকদের একই দামে কিনতে হচ্ছে প্রতি কেজি ঢেঁড়স। প্রতি কেজি বরবটি, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, কচুর লতি প্রভৃতির দামও ১০০ টাকার আশপাশে। প্রতি কেজি রসুনের দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। প্রায় একই দামে বিক্রি হচ্ছে আদাও।
টিসিবির তথ্যানুযায়ী, গত সপ্তাহে ৭০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ গতকাল শনিবার বিক্রি হয় ৯০ থেকে ১১০ টাকায়। ৭০ থেকে ১০০ টাকা দামের আমদানি করা পেঁয়াজ গতকাল বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। গত সপ্তাহে ৮৬ থেকে ৯০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হওয়া সয়াবিন তেল গতকাল বিক্রি হয় ৮৮ থেকে ৯০ টাকা। ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরের চিনি গতকাল বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ১০০ থেকে ১১০ টাকা লিটার দরের বোতলজাত সয়াবিন তেল এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানায় টিসিবি।
সংস্থাটির মতে, এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি সাধারণ চালের দাম বেড়েছে দুই দশমিক ৯৪ শতাংশ, মোটা চালের দাম তিন দশমিক ০৮ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম ১৮ শতাংশ। এক মাসে ২০ শতাংশ এবং এক বছরের ব্যবধানে ৬৫ শতাংশ বেড়েছে শুকনো মরিচের দাম। তুরস্কের ডাল এক বছরের ব্যবধানে ১৮ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। দেশি মসুর ডালের দাম বেড়েছে এক বছরে ১৭ শতাংশ।
এ দিকে ভরা মওসুমেও সবজির দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। খুচরা বাজারে গতকাল প্রতি কেজি শিম বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৫০ টাকায়। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। একই দামে বিক্রি হচ্ছে গাজর এবং শসা। ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। আর মুলা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়। প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। প্রতি কেজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি শালগম ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং একেকটি লাউ ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। পাকিস্তানি কক মুরগি ২১০ থেকে ২৪০ টাকা, লেয়ার মুরগি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, দেশী মুরগি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। এ ছাড়া গরুর গোশতের কেজি ৫৩০ থেকে ৫৫০ টাকা এবং খাসির গোশত ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। দেশী হাসের ডিমের ডজন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, ফার্মের মুরগির ডিম ৯৫ থেকে ১০০ টাকা এবং দেশী মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়।
মাছের বাজারে প্রতি কেজি রুই বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা দরে। প্রতি কেজি কাচকি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা, মলা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, ছোট পুঁটি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, শিং ৩৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, চিংড়ি ৫৫০ থেকে ৯০০ টাকা, দেশী চিংড়ি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, মৃগেল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, পাঙ্গাশ ১২০ থেকে ২২০ টাকা, তেলাপিয়া ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা, কৈ ২০০ থেকে ২২০ টাকা, কাতল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জর্জরিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে অনেকটা নীরব মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। নতুন বিনিয়োগ নেই, পুরনো বিনিয়োগও ঝুঁকিতে। একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলছে ব্যাপক ছাঁটাই। মানুষ বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে আরো অসহায় করে তোলা হয়েছে। এক দিকে মানুষের আয় কমছে। অন্য দিকে ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাড়ির মালিক বাসাভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। দোকানি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছেন আর সরকার বাড়িয়েছে নানান ধরনের ট্যাক্স। এভাবে চলতে থাকলে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ শুরু হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এ দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য যাতে না বাড়ে সে জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। রমজানে সবধরনের পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির পাঁয়তারা ও অবৈধ মজুদ রোধে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
মন্ত্রণালয় জানায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর খোলাবাজারে ভর্তুকি মূল্যে সর্বোচ্চ ২০ গুণ বেশি রমজানসংশ্লিষ্ট ছয় পণ্য বিক্রি করবে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। প্রতি বছর টিসিবি সয়াবিন তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর বিক্রি করে। বর্তমানে পেঁয়াজের দাম বেশি হওয়ায় এ বছর রমজানকে কেন্দ্র করে টিসিবির বিক্রির তালিকায় পেঁয়াজও যুক্ত হয়েছে।
রোজা সামনে রেখে ৩০ হাজার টন সয়াবিন তেল ও ২৫ হাজার টন চিনি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব পণ্য টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বিক্রি করা হবে। এ ছাড়া বাজারে সব ধরনের মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করবে মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ১৯টি মনিটরিং টিম সাজানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্মকর্তাদের নেতৃত্বেও বাজার মনিটরিং চলবে। মনিটরিং চলবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন অপর সংস্থা-বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উদ্যোগেও।
দ্রব্যমূল্যের এমন বল্গাহীন ঊর্ধ্বগতির জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি অধিকাংশ আমদানিপণ্যের উৎসস্থল চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় চীন থেকে। এর বাইরেও কাপড়, আদা, রসুন, বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যসামগ্রী, মেশিনারি, খুচরা যন্ত্রাংশ, খেলনা, মোবাইল, বৈদ্যুতিক সামগ্রী মিলিয়ে শত শত পণ্য আমদানি করা হয় চীন থেকে।
সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হচ্ছে তৈরী পোশাক ও এর কাঁচামাল আমদানি; যা চীনের বাইরে প্রত্যাশা করাটাও অসম্ভব। চীনে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। দেশটির ভেতরে এ সংক্রমণের প্রভাব এত তীব্র যে চীনের অধিকাংশ অফিস ও ব্যাংক নববর্ষের ছুটির পর এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। চেষ্টা করেও সেখানে এলসি খুলতে পারছেন না বাংলাদেশী আমদানিকারকরা।