হজ মুসলিমদের পবিত্র ইবাদত। কয়েকটি শর্তে ফরজ ইবাদতের একটি। কিন্তু হজকে ঘিরে চলা নানা অনৈতিক ক্রিয়াকর্ম এর পবিত্রতায় ছেদ ফেলছে কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নির্ধারিত কোটা খালি রেখে হজফ্লাইট শুরু হওয়াও এ অনৈতিকতার জের। তা শুরু হবে ২১ মে। এর দু’দিন আগে ১৯ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হজকার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। অব্যবস্থাপনা-অসন্তোষ কোন্ পর্যায়ে গেলে হজের নিবন্ধন করেও ৬৭৩ জন ব্যক্তি নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করেছেন।
কেন বা কোন কারণে তারা নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করেছেন তা জানে না ধর্ম মন্ত্রণালয়। কোন্ মাত্রার মশকরা? পবিত্র ইবাদতটিকেও কোথায় এনে ঠেকানো হয়েছে ? অথচ সরকারি মহল থেকে এটিকে কোনো ঘটনাই মনে করা হচ্ছে না। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছেন, হজের খরচ কমানোরও সুযোগ নেই। সম্প্রতি সচিবালয়ে ‘ই-হজ বিডি’ নামক মোবাইল অ্যাপ উদ্বোধনের পবিত্রক্ষণে তিনি এ কথা জানান দেন। দিনটিতে ছিল হজ নিবন্ধনের বিশেষ তারিখ। এরপরও কোটা পূরণ হয়নি। ফলে এবার প্রায় সাত হাজার কোটা খালি রেখেই হজফ্লাইট শুরু হচ্ছে।
এখানেও মন্ত্রণালয়ের যদি-তবে যুক্ত কথার প্যাঁচ। মন্ত্রণালয় বলছে, হজগাইড ও মোনাজ্জেম মিলে আরো সাড়ে তিন হাজার কোটা পূরণ হবে। তখন আর সাত হাজার খালি, বলা যাবে না। বলতে হবে, মাত্র সাড়ে তিন হাজার। খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবার নয় দফা সময় বাড়িয়েও হজের কোটা পূরণ না হওয়ার জন্য দায়ী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এই কোটা খালি থাকাকে কোনো সমস্যা মনে করেন না। তা আগামী হজে প্রভাব ফেলবে না বলেও কনফিডেন্স তার। হজ শেষ হলে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত থেকেও হজযাত্রী কমে গেছে- এমন তথ্য বাঙালি জানতে পারবে বলে অপেক্ষায় থাকতে বলেছেন প্রতিমন্ত্রী।
হজের খরচ বাড়িয়ে দেয়ার যন্ত্রণাকে আমলে নিতে নারাজ সরকার। সরকারিভাবে একটিমাত্র প্যাকেজ ঘোষণা করায় এবার হজযাত্রীদের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। একটি প্যাকেজে বিমান ও বাড়ি ভাড়া অস্বাভাবিক বাড়ানোর ফলে সরকারি-বেসরকারি উভয় হজযাত্রীদের ব্যয় বেড়েছে। তুলনামূলক ভাবেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেসরকারি হজযাত্রীরা। অন্যান্য বছর হজ নিবন্ধনের সুযোগ পেতে প্রতিযোগিতা চলত। এ বছর ৯ দফা সময় বাড়িয়েও কোটা পূরণ হয়নি। অন্যান্য বছর সরকারিভাবে প্যাকেজ ঘোষণা করা হতো দুটি। এতে অপেক্ষাকৃত কম দামি প্যাকেজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হজপ্যাকেজ ঘোষণা করে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো। অন্তত লাখ খানেক টাকা কমে হজে যাওয়ার সুযোগ হতো। এমন অব্যবস্থাপনা একদম ঠাণ্ডা মাথায় তৈরি করা হয়েছে। তার ওপর হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মূল নেতৃত্বে থাকা শীর্ষ কর্তাদের হজ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন অভিজ্ঞরা। নানান সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
ইবাদতকে ব্যবসায় নিয়ে ঠেকাতে কামিয়াব এ মহলটি বরাবরই কোনো না কোনোভাবে লাভবান। গত বছর বিভিন্ন হজ টিমে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের সৌদি আরব নেওয়ার অভিযোগ থাকা ব্যক্তিটির কোনো বিহিত না করে এবার আরো ক্ষমতাবান করা হয়েছে তাকে। এবার হজযাত্রীর কোটা পূরণ না হওয়ায় আগামী বছর হজের খরচ আরো বাড়ার অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে গত ২ এপ্রিল সরকারিভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। সরকারি পর্যায় থেকে এমন আগাম ঘোষণার বৈধতার প্রশ্ন হালে পানি পায়নি। হজ নিয়ে খরচের ধাপ্পাবাজির পরতে পরতে টাকার অঙ্ক। সরকারি হজ প্যাকেজের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রেখেছে সৌদি আরবের হারাম শরিফের কাছের বাড়ি ভাড়া ও বিমান ভাড়া। এ ক্ষেত্রে বিমান ভাড়া কমাতে পারে সরকার। হজ প্যাকেজের খরচে ১৬ ধাপের মধ্যে বিমান একটি। বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো শুধু বিমান ভাড়াকেই টার্গেট করেছে। কারণ বিমান ভাড়া কমালে এজেন্সি মালিকদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু হজ প্যাকেজের বাকি ১৫ ধাপের মধ্যে বাড়ি ভাড়া কমানো হলে এজেন্সি মালিকদের ব্যবসায় কম লাভ হবে। অনেক এজেন্সি হজের সময় মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবসা করে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে দফায় দফায় নিবন্ধন পেছানোর রহস্য আরো নানা দিকে ছড়ানো। এ ইবাদতটির সঙ্গে বেশ অর্থনৈতিক সংযোগ। এ সুযোগে বণিকরা হজকে করে ফেলেছে বিজনেস আইটেম। ব্যবসা হাতানোর প্রবণতায় অনেকে ঝুঁকেছেন এ ব্যবসায় যাদের অনেকে আবার ম্যান পাওয়ার ব্যবসায় সম্পৃক্ত। হজ তাদের কাছে একটি মৌসুমি ব্যবসা। তাদের অফিস থাকে। নতুন করে অফিস নিতে হয় না। আদম বেপারিদের মতো তাদেরও সংগঠন আছে। হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-হাব নামের সংগঠনটি তা দেখভাল করে।
প্রতি বছর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করে হাব। সরকারি প্যাকেজ মূল্যের ওপর ভিত্তি করে হজের প্যাকেজ সাজায় তারা। গত বছরের হজ প্যাকেজের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ও আসার বিমান ভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) বিমান ভাড়া ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তা ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০১০ সালে সরকারি হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া ছিল ৯৬ হাজার ৪২৫ টাকা। সেই হিসাবে দেড় দশকের কম সময়ে হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিমান ভাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে মক্কা ও মদিনায় হজযাত্রীদের জন্য বাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয়।
হজ একটি বড় রকমের ইবাদত বলে এর দিকে ব্যবসায়িক নজর থাকবে না-এমন নীতিকথার সুযোগ নেই। নীতি-নৈতিকতা, ভয়, ভক্তি এখানে খাটে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তো হজ নিয়ে এতো ব্যবসা হয় না, সে কথা বলার জায়গাও নেই। বরং ‘কেউ না গেলে নাই’- এমন সাফ কথার বাজার আছে। হজপ্রার্থীরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খরচের তফাত জানেন না, এমনও নয়। নিজ গরজেই তারা তা সংগ্রহ করেন। কিন্তু, তাতে কিছু যায়-আসে না। জনসংখ্যা বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার হজযাত্রীদের খরচ অনেক কম। জনপ্রতি দুই লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৩ টাকার বেশি নয়। হজযাত্রায় আরো টাকা লাগলে তা দেশটির সরকারের ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। মালয়েশিয়া থেকে হজে যেতে সর্বনিম্ন দুই লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা ও সর্বোচ্চ দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি বছর হজে ভর্তুকি হিসেবে মালয়েশিয়া সরকার ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। প্রতিবেশী ভারতে হজে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হলেও খরচ আমাদের মতো নয়। এসব নিয়ে প্রতি বছরই কথা হয়। বচসা জমে। কারো পছন্দ না হলে বা সামর্থ্যে না কুলালে না যাবেন- এ সাফ কথায় বাদবাকি যুক্তি আর টেকে না।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে হজের জন্য সর্বনিম্ন খরচ ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে তিন লাখ চার হাজার টাকা। ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল তিন লাখ ১৯ হাজার টাকার। ২০১৮ সালে ছিল তিন লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে তিন লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারীর কারণে ২০২০, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে সীমিত পরিসরে হজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছিল চার লাখ ৫৬ হাজার। এসব হিসাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হলেও খরচের তারতম্য বিস্তর। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে তিন লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর গত বছরের তুলনায় দুই লাখ ১৬ হাজার টাকা। অথচ এবার সৌদি সরকার হজে আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। মোয়াল্লেমের খরচ কমিয়েছে। এ ছাড়া হজের সময় সৌদি সরকার নানা ধরনের সুবিধা বিনা মূল্যে প্রদান করে। মক্কা থেকে আরাফাহ, মিনা, মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য বিনা মূল্যে পরিবহনব্যবস্থা থাকে। সরকারের পাশাপাশি, সৌদি আরবের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি বিনা মূল্যে পরিবহনসুবিধা দিয়ে থাকে। হজ ব্যবসায়ীরা এ তথ্যগুলো আলোচনায় আনেন না। এ প্রসঙ্গে কথা আনলে তারা সাইড কেটে চলে যান অন্যদিকে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট