এ বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ২২টি বইয়ে ৪২১টি ভুলভ্রান্তির সত্যতা পেয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ভুলগুলো সংশোধন করে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সংশোধনী দেয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে দু’টি প্রশ্ন উঠে আসছে। এক. জাতীয় শিক্ষাক্রমের বইয়ে কেন ভুল ও ভ্রান্তি থাকবে? এই কর্তৃপক্ষই তো পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত ও মুদ্রণসহ যাবতীয় বিষয় তদারকি করে। মুদ্রণের আগে বইগুলো সম্পাদনা করেন এনসিটিবির নির্ধারিত প্রজ্ঞাবানেরা। যারা ওই সব বই লিখেছেন তারা শিক্ষাক্ষেত্রের প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী মানুষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের টাকা দিয়ে পাঠ্যক্রেমের বিষয় লিখিয়ে নিয়েছেন। আবার আরো বড়মাপের জ্ঞানীরা সেগুলো পরখ করেছেন যাতে কোনো ভুলভ্রান্তি না থাকে। ওই দুই স্তরের প্রজ্ঞাবানদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়েছে সামান্য ৪২১টি ভুল। এই ভুলের খেসারত কে দেবে?
দুই. যারা এডিটর বা সম্পাদক/সংশোধক হিসেবে কাজ করেছেন, এই উভয়ই যে বইগুলোর বিষয় ও লিখিত বিষয়ের ভুলগুলো বুঝতে পারেননি বা বোঝার মতো জ্ঞান-গরিমা ছিল সীমিত, তা তো ওই ৪২১টি ভুলই প্রমাণ করে দিচ্ছে। ওই সব লেখক ও এডিটরদের কেন এনসিটিবি, বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়েছিলেন?
নিয়োগকর্তাদের জ্ঞানের বহর কি ওই লেখক ও এডিটরদের মতোই সীমিত বা ভাসা ভাসা? গুগল থেকে কপি করে নেয়া ভাষাও তারা বুঝতে পারেননি? ফলে যা লেখা হয়েছে, তাই ‘যথার্থ’ বলে মার্ক দিয়ে ছাপতে দিয়েছেন। এই যে ভুলভ্রান্তি, তা তাদের জ্ঞানে ধরা না পড়লেও সাধারণ মানুষের জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় তা ধরা পড়েছে এবং এনসিটিবি ও মাউশি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা মেনে নিয়ে আরো বড় মাপের জ্ঞানীদের দিয়ে তা সংশোধন করিয়ে এখন তাদের ওয়েবসাইটে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে প্রত্যেক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে পাঠানো হয়েছে ওই সংশোধিত অংশ। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে সেই সংশোধিত অংশটুকু শিক্ষার্থীদের দেয়া। স্কুল ফান্ডে টাকা থাকলে এবং ধারে কাছে ফটোস্ট্যাটের দোকান থাকলে তিনি ফটো কপি করে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করবেন। কিন্তু সবাই কি তা করেন ও করবেন? এতে সন্দেহ করার বহু কারণ আছে। প্রধানশিক্ষক তার গাঁটের পয়সা খরচ করে ওই কর্তব্য পালন করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো মাউশি বা এনসিটিবি কেন সংশোধিত অংশ ফটো কপি করে প্রত্যেক স্কুলের ছাত্রদের দেয়ার আয়োজন করলেন না? দায়িত্বটা তো তাদেরই। বই ছাপতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেন, আর সংশোধিত অংশ শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর জরুরি দায়িত্বটি কেন ওয়েবসাইটে বা প্রধান শিক্ষকের কাঁধে চাপালেন? এনসিটিবি বা মাউশি কেন ইতিকর্তব্য পালনে গড়িমসি করলেন এবং নিজেদের দায়িত্ব স্কুলশিক্ষকের কাঁধে চাপালেন?
পাঠ্যপুস্তকে ভুল ও তা সংশোধনের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটি দোষীদের ব্যাপারে রিপোর্ট করে তা শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির কাছে দিয়েছিল। কিন্তু ডা: দীপু মনি সেই রিপোর্ট নেননি। তিনি আরো সফট করে রিপোর্ট করতে বলেছিলেন। আগের রিপোর্টটিতে নাকি দোষীদের ওপর কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রস্তাব ছিল। তাই শিক্ষামন্ত্রী রিপোর্ট সফট/নরম করে লিখতে বলেছেন। তা তিনি বলতেই পারেন, সেই অধিকার তো তার আছে। দোষীরা যে তার নিজস্ব লোক, তার রাজনৈতিক সহযোগী, তার ইচ্ছারও অধীন লেখক ও সম্পাদকগণ, তাদের বাঁচানো তো তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
অভিযোগ রয়েছে, পাঠ্যবইয়ে ভুল চিহ্নিত করে সংশোধনী কপি প্রকাশ করা হলেও যারা এই ভুল করেছেন তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো চিহ্নিত করেনি। এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও পছন্দসই প্রতিবেদন না হওয়ায় সেটি গ্রহণ না করে নতুন করে প্রতিবেদন লিখে দিতে বলা হয় তদন্ত কমিটিকে। বাধ্য হয়ে পছন্দমতো একটি প্রতিবেদন তৈরি করে দেয় তদন্ত কমিটি। (ভোরের কাগজ ৩০ এপ্রিল ২৩)
আগে যে তদন্ত রিপোর্ট হয়েছে, সেটা গৃহীত হয়নি, সেটা তো সরকারি সম্পত্তি, সেই রিপোর্ট ধামাচাপা দিলেও একদিন না একদিন তা প্রকাশ হবেই। তখন জানা যাবে কারা সেই দোষী এবং কাদের বাঁচানোর জন্য মন্ত্রী মহোদয়া ওই রিপোর্ট প্রকাশ না করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই তথ্য জানিয়েছেন।
মাননীয়া নিজের লোকদের সম্মান রক্ষার যে কৌশল নিয়েছেন তা একটি বজ্র্র-আঁটুনি ফসকা গেরো মাত্র। ওই গেরো খুলবেই এবং দোষীদের জ্ঞানময় মুখগুলো জাতি জানতে/দেখতে পাবেই। তবে, এই সরকারের যা ক্ষতি তা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। নতুন কারিকুলাম আর তাদের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রকল্প যে জাতির মেরুদণ্ড নড়বড়ে করে দেয়ার আয়োজন, এটা আজ স্পষ্ট। এটা বোঝার পরও কেন যে ক্ষমতাবানেরা দোষীদের কলঙ্কময় মুখ ঢেকে রাখতে তৎপর, তা আমরা বুঝতে পারি না।
আর একটি প্রশ্ন ওই দোষীগণ যে জাতির বিরুদ্ধেই সরকারের ভেতর মহলে ঢুকে এ রকম কাজ করছে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? সরকার যখন তার রাজনৈতিক ইমেজে উন্নয়নের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে, দক্ষিণা বাতাসে যখন সেই পতাকা পতপত করে উড়ছে, তখন শিক্ষা সংক্রান্ত এই ঘোলাজল তাতে কালি লেপে দেয়নি কি? সরকার যদি মনে করে থাকেন যে তারা যা ভালো বোঝেন ও মনে করেন, বাকিরা, মানে জনগণ তা বোঝে না, তাহলে তা হবে সরকারের মেগা ভুল-ভাবনা। আপাতত এটা মনে হয় যে পাঠ্যপুস্তকের এই ভুলভ্রান্তিগুলো বড় কিছু নয়, তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে এটা বঙ্গবন্ধু টানেল বা পদ্মা সেতু প্রকল্প নয়, পাঠ্যপুস্তকের ভুলভ্রান্তি গোটা জাতির আগামী দিনের শিশুদের মনন ও মানস গঠনের বিষয়। ভুল শিক্ষায় তারা শিক্ষিত হলে জাতির মেরুদণ্ডই তো বেঁকে যাবে। যারা এটা চায় তারাই তো ভুল পাঠ দেয়ার আয়োজন করেছেন। এবং তাদের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা এটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
প্রশ্ন উঠেছে, পাঠ্যবইয়ে ভুলের সংশোধনী দেয়ার পর কী কাজে লাগে? বছর বছর ভুল হয়, বছর বছর সংশোধনীও দেয়া হয়। কিন্তু সেই সংশোধনী কি শিক্ষকরা ঠিকমতো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে দেন? শিক্ষার্থীরা কি সংশোধিত পাঠ্যবই নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে? শিক্ষা প্রশাসনের ‘গা ছাড়া’ মনোভাবের কারণেই এমনটি হয়ে আসছে বলে জানা গেছে।
পছন্দ মতো প্রতিবেদন পেয়ে নিশ্চয় সংশ্লিষ্টগণ খুশি। কিন্তু আমরা খুশি হতে পারছি না। কারণ, ওই ভুলে-ভরা বই তো আমার সন্তান পড়ছে। তারা তো মিথ্যা কিংবা বানোয়াট-সত্য শিখছে, যা আরো মারাত্মক অধঃপতন ডেকে আনবে। আর সেটা তো ধামাচাপা দিতে পারবেন না সরকার।