বাংলাদেশের বাইরে গড়ে উঠেছে বৃহত্তর এক বাংলা। বহুজাতি ও সংস্কৃতির দেশ আমেরিকায় বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশি খাবারের নাম। একসময় ভারতীয় খাবার (ইন্ডিয়ান ফুড) হিসেবে পশ্চিমের এ দেশে পরিচিতি পেত বাংলাদেশি খাবার। এখন বাংলাদেশের সেই খাবার পশ্চিমা মানুষের মধ্যেও নিজস্ব পরিচয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর সবই হচ্ছে প্রবাসে জন্ম বা বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। আমেরিকার মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এখন আলোচিত হচ্ছে এমন কিছু উদ্যোগের কথা।
আমেরিকার মূলধারার খাদ্য সাংবাদিকেরা (ফুড জার্নালিস্ট) বেশ সমীহের সঙ্গেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিনদের হাত ধরে চালু হওয়া রেস্টুরেন্ট ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে লিখছেন। এনবিসি নিউজের মতো সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে এসেছে, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নয়, খাঁটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট ‘কড়াই কিচেন’। ৩২ বছর বয়সী বাংলাদেশি আমেরিকান নুরে ফারহানা রহমানের উদ্যোগ এই খাবারের রেস্টুরেন্ট। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার কাছে দেওয়া বক্তব্যে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ফারহানা জানালেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন হিসেবে আত্মপরিচয় নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নিজের এগিয়ে যাওয়ার কথা। বললেন, বাংলাদেশি খাবারের দোকানের প্রতীক হইয়ে উঠেছে জার্সি সিটির সামিট অ্যাভিনিউয়ের তাঁর ‘কড়াই কিচেন’।
পশ্চিমের অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকায় ভারতীয় খাবারের পরিচয়ে ‘চিকেন টিক্কা মশল্লা’ পরিচিত হয়ে উঠে। এক শ বছর ধরে আমেরিকায় উপমহাদেশীয় খাবারের পসরাগুলো ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ নামেই পরিচিত হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার আলাদা কোন খাবার-সংস্কৃতি পরিচিত হয়ে ওঠেনি তেমন করে। বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টেও সাইন ঝুলাতে দেখা যায়, এখানে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি খাবার পাওয়া যায়। খাদ্য বৈচিত্র্যে, স্বাদে ব্যাপক ফারাক থাকার পরও বাংলাদেশিরা দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় অর্ধশত বছর পরও পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের খাদ্য পরিচয়ে পরিচিতি অর্জন করতে পারেননি। এমনকি যুক্তরাজ্যের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বাংলাদেশিদের আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও, জনপ্রিয় হলেও খাবারটি ভারতীয় খাবার নামে পরিচিত।
আমেরিকার বিখ্যাত জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ফারহানা রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের পূর্বসূরিরা নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে ভারতীয় রেস্টুরেন্টের নামে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে অবস্থান নেওয়ার দুর্বার তাড়নাই ফারহানাকে ‘কড়াই কিচেন’ ব্যবসায় নামিয়েছে। ফারহানার মা নুরে গুলশান রহমানকে নিয়ে তাদের এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা।
গুলশান রহমান প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে বলেন, নিজে বগুড়া থেকে এসেছেন। স্বামী মাহবুবার রহমান নোয়াখালী থেকে। নিজেদের প্রবাস যাত্রার শুরুতে ভিন্ন কাজ ও ব্যবসা করেছেন। তিনি বললেন, মেয়েকে নিয়ে শুরু করা ব্যবসা শুধু ব্যবসাই নয়। নিজের দেশ, নিজের স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে তাঁদের এই ব্যবসা।
রেস্টুরেন্ট নিয়ে প্রতি বছর রেটিং করে থাকে ইয়েল্প নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত বছরে রেস্টুরেন্ট রেটিংয়ে ‘কড়াই কিচেন’ শীর্ষে ছিল। বাংলাদেশিদের জন্য আমেরিকায় এ এক বিরাট অর্জন বলে মনে করেন নিউইয়র্কে বসবাসরত প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান। ফারহানা তাদের রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশি স্বকীয়তা দেখানোর জন্য # নোচিকেনটিক্কামশাল্লা হ্যাশট্যাগ দিয়ে নিজেকে ব্র্যান্ডিং করছেন।
নিউইয়র্ক নগরে যেসব তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ চালু আছে, তার সিংহভাগ পরিচালনা করেন অভিবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশের লোকজনের এই প্রয়াসের কৃতিত্ব যায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের নামে। এর অবসান ঘটছে দ্রুতই। খাদ্য লেখক কৃষ্ণেন্দু রায় বেশ আগেই ইংল্যান্ডে বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট ও খাবার বৈচিত্রের কথা লিখেছেন তাঁর ‘দ্য এথনিক রেস্টুরেন্ট’ বইয়ে। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার লোকজন বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে আসলেও আমেরিকায় বাংলাদেশিদের নানা অঞ্চল থেকে আসা লোকজন এই বাণিজ্যে ছড়িয়ে পড়েছেন।
ভারতীয় লেখক কৃষ্ণেন্দু রায় তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থে বলেছেন, প্রথম দিকের অভিবাসীরা তাদের সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষাকে ব্র্যান্ডিং না করে তাদের পরিবারকে খাওয়ানোর বোঝা নিয়ে এসেছিল।
গত এক দশক ধরে দক্ষিণ এশীয় কিছু রেস্তোরাঁ আরও স্বতন্ত্র পরিচয়ের ওপর জোর দেওয়া শুরু করেছে। এবং এই আন্দোলনটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গতি পেয়েছে। মূলত তরুণ দক্ষিণ এশীয় উদ্যোক্তারা তাদের অনন্য ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য খাদ্য সংস্কৃতির উদ্যোগ ব্যবহার করছেন।
ম্যানহাটনের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসেবে খ্যাত অধিকাংশ রেস্টুরেন্টই বাংলাদেশি অভিবাসীদের মালিকাধীন। কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে সাগর চায়নিজ বা ব্রঙ্কসের খলিল রেস্টুরেন্ট এখন শুধু বাংলাদেশিদের গন্তব্য নয়, আমেরিকার মূলধারার সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জ্যাকসন হাইটসের মতো জায়গায় ডেরা রেস্টুরেন্ট পাকিস্তানি অভিবাসীরা চালান। এক দশকের বেশি সময় ধরে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চললেও ডেরা রেস্টুরেন্টকে আমেরিকানরা চেনে ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ হিসেবে। ‘পাকিস্তানি, ভারতীয়, বাংলাদেশি, নেপালি’ ম্যানু দিয়ে খাবার সরবরাহ করা হলেও নিজেদের কোন পরিচয় নেই পাকিস্তানি সফল এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীর।
বাংলাদেশিরা এখন নিউইয়র্কের স্ট্রিট ফুড বাণিজ্য ক্রমশ দখলে নিচ্ছেন। একসময় ‘স্ট্রিট ফুড’ বাণিজ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীদের আধিপত্যে থাকলেও বাংলাদেশি ফুড কার্ট (চলমান খাবার গাড়ি) এখন নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে দেখা যায়। অবশ্য এসব খাবার এখনো বাংলাদেশি খাবার হিসেবে আলোচনায় আসেনি।
ফারহানা রহমানের ‘কড়াই কিচেন’, সাগর চায়নিজ বা খলিল বিরিয়ানি আমেরিকার মূলধারার জনসমাজে ক্রমশ আলোচনায় চলে এসেছে। চায়নিজ ফুড, ইতালীয় ফুড, মেক্সিকান ফুডের মতো বাংলাদেশি ফুড পশ্চিমের দেশ আমেরিকায় বাংলাদেশিদের অগ্রযাত্রার এক উজ্জ্বল প্রতীক বলেই মনে করা হচ্ছে।