আখ ব্যবসায়ী আহমদের গুলি লেগেছে। রক্ত দরকার। হাসপাতালে তার জন্য রক্ত খুঁজছেন গোপাল। অটোচালক অনিলের মাথায় বাইশটি সেলাই। মাথায় রক্ত জমে আছে। হাসপাতালে তার স্যালাইনের বোতল ধরে ঠায় বসে বৃদ্ধ সবজি বিক্রেতা আবেদ। গল্প নয়। সিনেমার দৃশ্য নয়। এ দৃশ্য দিল্লির হাসপাতালের, যে দিল্লি জ্বলছে। এবং ওই আবেদ-গোপালরা আছেন বলেই বাকি ভারত জ্বলছে না। বরং সংযত, ভারতের রাজধানীর রক্ত চুঁইয়ে পড়েনি অন্য কোথাও।
অথচ তা হতেই পারত। উপকরণ ছিল, কোথাও প্ররোচণাও ছিল। কিন্তু ভারতে আবারো ১৯৮৪ সাল ফিরে আসেনি। ফিরে আসেনি ১৯৯২ সালও। আর এটা ওই গোপাল আর আবেদের জন্য। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এইচ এলদাত্তু ঠিকই বলেছেন,‘এটা বলা যায় না যে, এটা একে অন্যকে ঘৃণা করার আন্দোলন। এটা বিচ্যুতি। গণতান্ত্রিক দেশে কিছু বিচ্যুতি থাকে। ভিন্ন মতও থাকে।’
দাত্তু কিন্তু গোপাল বা আবেদকে দেখেননি। কিন্তু তার কথার সুর বেঁধে দিয়েছেন ওই গোপাল আর আবেদ। ভারতবাসী জেনে খুশি হবেন, গাড়ি মেকানিক রাজেশের শিরা-ধমনিতে কুলকুল করছে ফলওয়ালা রহমানের রক্ত। সেই দিল্লিতেই, যে দিল্লি জ্বলছে।
দিলশাদ গার্ডেনের গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতাল। হন্যে হয়ে ঘুরছেন গোপাল। কপালে লাল তিলক। ‘ভাইয়া আপ কি ব্লাড গ্রুপ ক্যায়া হ্যায়?’ যাকে দেখছেন, বলছেন গোপাল। কিন্তু রক্ত মিলছে না। তার কানে ফোন, ‘আরে ভাই, গন্না ব্যাপারি (আখ ব্যবসায়ী) আহমেদ কো গোলি লগা হ্যায়, তুরন্ত অপারেশন হোগা, খুন চাহিয়ে, ও নেগেটিভ গ্রুপ কা, জলদি লাও।’
উত্তর-পূর্ব দিল্লির সংঘর্ষে গুলি লেগেছে আহমেদের পিঠে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। না-হলে ঘোর বিপদ। গোপালের কথায়, ‘দাদা, এটা হাসপাতাল। দেখবেন আসুন। রাজেশের দেহে কী করে ঢুকছে রহমানের রক্ত।’
হাসপাতালের দোতলায় বিশাল হলঘর। শত শত লোক শুয়ে কাতরাচ্ছে। কারও হাতে গুলি, কারও পায়ে, কারও পিঠে ছুরির দাগ। এক কোণায় শুয়ে অনিল। জ্ঞান প্রায় নেই। পাশে বসে আবেদ। হাতে স্যালাইনের বোতল ধরা। এতো রোগী যে, স্যালাইনের স্ট্যান্ড নেই। তাই হাতেই ধরে থাকতে হচ্ছে বোতল। অনিলের বাড়ি বিহারে। দিল্লির গোকুলপুরীতে তার প্রতিবেশী আবেদ। তিনিই রক্তাক্ত অনিলকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
আবেদ বলেন,‘জানেন, অনিল খুব ভালো ছেলে। কিছুদিন আগে ওর পরিবার গ্রাম থেকে এসেছে। এক ছেলে, এক মেয়ে। লেখাপড়ায় খুব ভালো। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু কী যে হয়ে গেল! আগে তো এমন দেখিনি। এক প্রতিবেশী মারছে অন্য প্রতিবেশীকে।’ তার পর দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে আবেদের। ‘আল্লাহ, দয়া করো, বাঁচা লে ইস বন্দে কো (আল্লাহ, দয়া করো, এই মানুষকে তুমি বাঁচিয়ে দাও)।’
ফিরে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ শোনা গেল একজন নারীর গলা,‘এখানে কোথায় থাকেন?’ পরিষ্কার বাংলা। ফিরে তাকালাম। প্রশ্ন করছেন মধ্যবয়সী বাঙালি নার্স। ‘আপনাকে ফোনে কথা বলতে শুনেছি একটু আগে বাংলায়। তখনই বুঝেছি আপনি বাঙালি। আমিও তাই, বাড়ি ছিল মালদায়। অনেক বছর এখানে আছি। তা কী বুঝছেন? কেন এই সংঘর্ষ?’ উত্তরের অপেক্ষায় না-থেকে নিজেই বলে গেলেন ভদ্রমহিলা, ‘জানেন প্রায় দুইশো লোক ভর্তি এখানে, গুলি লেগেছে অন্তত জনা বিশেকের। এত গুলি চলেছে এখানে? ভাবতেই তো কেমন লাগছে? এটা দেশের রাজধানী, পুলিশ, সেনা সব আছে। সেখানে গুলিতে লোক মরছে, দিনের বেলায়? কী অবস্থা ভাবুন তো?’
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার পথে দেখা রাহুল সোলাঙ্কি ও ফুরকানের পরিবারের সঙ্গে। বছর তেইশের রাহুল আর ৩২ বছরের ফুরকান। দু’জনেই গুলিতে নিহত হয়েছেন। একজন জাফরাবাদে, অন্যজন করদমপুরীতে। একজন দুধ আনতে বেরিয়েছিলেন, অন্যজন রুটি। বাড়ি ফেরেননি কেউই। পরিবারের লোক দু’দিন ধরে বসে হাসপাতালের মর্গের বাইরে। কিন্তু লাশ মিলছে না।
ওরা তো দাঙ্গা করতে যায়নি। এক জনের হাতে রুটি থাকার কথা ছিল। আর এক জনের হাতে দুধ। গোপাল-আবেদ-রাজেশ-রহমান আর কিছু চান না। একটু রুটি, একটা কাপড়, একটা ছাদ! তবে কেন এতো গোলাগুলি? সূত্র : এই সময়