মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বাড়তি সুবিধা বাতিল করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় দেশীয় সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে ঢাকা-ওয়াশিংটন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টির। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নাকচ করে বলা হচ্ছে দেশগুলো চাইলে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে এ সুবিধা পেতে পারে।
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এতোদিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশ ঢাকায় তাদের কূটনীতিক বিশেষ করে মিশন প্রধানদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে আনসার বাহিনীর একটি চৌকষ দলের সেবা পেতেন। যারা মূলত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতো। এখন থেকে আর সেটি বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি এখনো দূতাবাসগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আগামী রোববার নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। এরপরও যদি তাদের অতিরিক্ত সেবার প্রয়োজন হয় তবে তারা অতিরিক্ত পয়সা খরচ করে সেটি পাবে।
আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার ঢাকায় ২৩ দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে অপর এক বৈঠক শেষে বলেছেন, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়েই বাংলাদেশ বিদেশি কূটনীতিকদের জোরালো নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। যা পূর্বের মতোই বহাল থাকবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সব দেশেরই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। এটি একটি বাড়তি সুবিধা। তাই সরকার চাইলে সেটি বাতিল করতে পারে। আবার তারা চাইলেও সেটি টাকার বিনিময়ে নিতে পারে। তবে সেটি কোন প্রক্রিয়ায় নেওয়া সম্ভব কিংবা ইতোমধ্যে কোনো দেশ বাড়তি সুবিধা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানাতে পারেননি তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র সেহেলী সাবরীন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কূটনীতিকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তার বিষয়টি একটি মামুলী ইস্যু। এ নিয়ে কোনো দেশের সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল ভিত্তি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সেটি ঠিক থাকবে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ আগে থেকেই ঢাকার নাগালের বাইরে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃদেশীয় সফরে মনে করা হয়েছিলো এ দূরত্ব কিছুটা হলেও কমে আসবে। কিন্তু বিষয়টি হয়তো তার বিপরীতই হয়েছে। অন্তত কূটনীতিকদের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত সেটাই বলছে। আবার অনেকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান মানে কোবরা সাপের লেজে পা দেয়া। যদি এটা হয় তাহলে যে কোন সময় ছোবল খেতে হতে পারে।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের বিষয়টি খোলামেলা ভাবেই বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আমাকের আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না’।
ঢাকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি মামুলী হলেও প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর এসকর্ট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত গুরুতর কিছুর ইঙ্গিত করে। স্পস্টতই এখানে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে দূরত্ব দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় সেটি আগামী নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ি যে কোনো কূটনীতিকের নিরাপত্তার বিষয়টি স্বাগতিক দেশকেই নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
এদিকে রাজনীতির ময়দানেও বিষয়টি তুমুল ঝড় তুলেছে। ইতোমধ্যে সরকার বিরোধীরা এ বিষয়টিকে সামনে এনে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটলো। সরকার যখন কোনো কিছুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাগে আনতে পারছে না তখনই এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঢাকাস্থ সকল দেশের দূতাবাস ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় কোনো ছাড় দেবে না সরকার।
পতাকাবিহীন গাড়িতে মার্কিন দূত:
এদিকে বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা তথা স্থায়ী পুলিশি এসকর্ট আচমকা প্রত্যাহারের পর এই প্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো দাওয়াতে অংশ নিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। বাংলাদেশের স্থানীয় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজ কাম কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেন তিনি। অন্য সহকর্মীদের মতো যথাসময়েই মার্কিন দূত অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। তবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সরা অ্যাম্বাসেডরস কারে নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আসেন পতাকাহীন গাড়িতে।
যদিও তিনি তার জন্য নির্ধারিত অ্যাম্বাসেডরস কার-১ ই ব্যবহার করছিলেন। গাড়ির সামনে বা পেছনে ছিল না পুলিশ বা দূতাবাসের নিজস্ব কোনো প্রটোকল ব্যবস্থা। তবে রাষ্ট্রদূতকে বহনকারী গাড়ির সামনের সিটে ছিলেন কেবলমাত্র তার গানম্যান। দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ক্লোজ ডোর ওই ব্রিফিংয়ের পুরোটা সময় উপস্থিত এবং বেশ মনোযোগী ছিলেন পিটার হাস।
তিনি ব্রিফিংয়ে কোনো প্রশ্ন দূরে থাক, মুখে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি! এমনকি লাঞ্চের সময়ও নয়। অন্য দূতরা অবশ্য মধ্যাহ্নভোজে পরিবেশিত মৌসুমী ফল আমের উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।
কেউ কেউ পরিবেশিত আমের জাত সম্পর্কেও জানতে চেয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এটা নিশ্চিত করেছেন, ব্রিফিংয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ভারত ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সার্বক্ষণিক পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহার নিয়ে কোনো কথা হয়নি। যদিও সরকারের তরফে এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে জবাবে দেয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল। গত ১৪ মে থেকে ওই ৪ দেশের রাষ্ট্রদূতসহ কোনো কূটনীতিকই স্থায়ী বা অস্থায়ী পুলিশ এসকর্ট সুবিধা পাচ্ছেন না। সরকারি এক সিদ্ধান্তে দূতদের বিশেষ ওই এসকর্ট সুবিধা তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়। রাষ্ট্রদূতদের এসকর্ট সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সেদিন বলেছিলেন কেবল এসকর্ট প্রত্যাহারই নয়, রাষ্ট্রদূতদের গাড়িতে ফ্লাগ উড়ানোও বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
নিরাপত্তার নামে ৪/৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ‘বাড়তি ঢং করছিলেন’ মন্তব্য করে সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, নিউইয়র্কে ১৯৩টি দেশের স্থায়ী মিশন রয়েছে। সেখানে যে সমস্ত মিশন প্রধান দায়িত্ব পালন করেন তাদের অনেকেই নিজ নিজ দেশের কেবিনেট মেম্বার পদমর্যাদার। কিন্তু ওখানে কেউ পুলিশ এসকর্ট নিয়ে চলার চিন্তাও করতে পারে না। তিনি বলেন, আমি মন্ত্রী, কিন্তু কোথাও পুলিশ এসকর্ট নেই না। বাংলাদেশে রাস্তাঘাটে কিংবা শপিং মলে আক্রমণ করে লোক মারে না মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেছিলেন এখন কারও চলাফেরায় কোনো অসুবিধা নাই। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতে এসব ঢং নেই। সবমিলিয়ে আমরা উন্নত হচ্ছি। আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে উন্নত করতে হবে। কলোনিয়াল মেন্টালিটি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ভারত ও সৌদি আরব এই সুবিধা পাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ এই সুবিধা চাইছিল।
দিনে দিনে নতুন নতুন চাহিদা বাড়ছিল। আসলে নিরাপত্তা মূল কথা নয়, সামনে পেছনে পুলিশ নিয়ে একটু বাড়তি বাহবা নেয়া বা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনেক দূত এই সুবিধাটি চাইছিলেন। সরকার কৃচ্ছতাসাধন করছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেছিলেন রাষ্ট্রদূতদের পয়সা দিয়ে এসকর্ট সুবিধা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বহু আগে। কিন্তু একজন রাষ্ট্রদূতও সরকারের সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। কোনো মিশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দেয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি বলে অভিযোগ করেছিলেন মন্ত্রী। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে ঢাকায় কমর্রত বিদেশি কূটনীতিকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন।
তাৎক্ষণিক তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের হতাশার কথা সেগুনবাগিচাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান। কূটনৈতিক এবং সরকারি সূত্র বলছে, পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহারে এরইমধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেগুনবাগিচাকে সেই ক্ষোভ এবং হতাশার বিষয়টি দূতাবাসের মাধ্যমে জানানো হয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের প্রধান শন ম্যাকিনটো বলেন, ‘আমাদের কূটনৈতিক কর্মীদের এবং সুবিধাসমূহের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী, আমরা মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশদ প্রকাশ করি না।
ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে, অবশ্যই সমস্ত কূটনৈতিক মিশন এবং কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বাগতিক দেশের বাধ্যবাধকতা বজায় রাখতে হবে।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলও প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে, যেকোনো স্বাগতিক দেশকে অবশ্যই ‘সব কূটনৈতিক মিশন প্রাঙ্গণ ও কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তার বাধ্যবাধকতা বজায় রাখতে হবে এবং কর্মীদের ওপর যেকোনো আক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত সব পদক্ষেপ নিতে হবে।’