মাশরাফি। পুরো ক্যারিয়ারটাই তার মহাকাব্যিক। ইনজুরির কালো থাবা ও হতাশা তার কাছে পরাজিত হয়েছে। প্রতিবার সেই অবিশ্বাস্য ‘হাঁটুর’ জোর ফিরিয়ে এনেছে ২২ গজের উইকেটে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অধিনায়ক মাশরাফির ইতি ঘটবে এমনটাই কথা ছিল। কাল লাক্কাতুড়া চা-বাগান সংলগ্ন মনোহরী সিলেটের আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সেই অগ্নিশর্মা, অবিশ্বাস্য ও আত্মবিশ্বাসী মাশরাফিকে দেখা গেল। তিনি মচকাবেন, তবে ভাঙবেন না। আজ শুরু হচ্ছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। প্রথম ম্যাচের আগে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নানা কথা বলেছেন। প্রায় বিশ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে চলা এ সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি কখনো কথার বাউন্সারের জবাব দিয়েছেন ছক্কা হাঁকিয়ে, কখনো কেতাবি ঢঙ্গে ডিফেন্স করেছেন। কখনো আবেগতাড়িত হয়েছেন কখনোবা নিজের স্বভাবসিদ্ধ সীমাও অতিক্রম করেছেন। তবে এখনই অবসর নিতে চান না নড়াইল এক্সপ্রেস। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : বোর্ড সভাপতি বলেছেন এটাই অধিনায়ক হিসেবে আপনার শেষ সিরিজ, স্পষ্ট করবেন?
মাশরাফি : স্পষ্ট করার কী আছে, আমার তো মনে হয় সবই বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলেছেন। আমার সঙ্গে যে কথা হয়েছে মনে হয় না এখানে শেয়ার করা প্রয়োজন। ক্রিকেট বোর্ড কী বলেছে আপনারা তো জানেনই। আমার মুখ থেকে আবার শুনতে হবে কেন?
প্রশ্ন : প্রায় আট মাস পর মাঠে ফিরছেন, লক্ষ্য কী?
মাশরাফি : অবশ্যই পারফরম করা। একটা খেলেয়াড়ের জন্য এটিই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শেষ কয়েকটা ওয়ানডেতে জয় পাইনি। জেতাটাই গুরুত্বপূর্ণ। রাইট ট্র্যাকে আসাটা।
সবাই চায় পারফরমেন্স। আমার ক্ষেত্রেও এর বাইরে কিছুই নয়। আমি চেষ্টা করব একই সঙ্গে টিম ওয়ার্ক ও জেতাটা গুরুত্বপূর্ণ। দুইটা মিলিয়ে চেষ্টা করতে হবে।
প্রশ্ন : অধিনায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন পর ফিরেছেন। একটা গ্যাপ ছিল, দলে কিছু পরিবর্তন হয়েছে, এখনকার পরিবেশ কেমন?
মাশরাফি : আমার কাছে মনে হয় সবাই খেলার মধ্যেই ছিল। ওয়ানডে তো ছিল না। কোনো কিছুর পরিবর্তন হয়নি। সবাই প্রফেশনাল। যার যার দায়িত্ব সবাই জানে। আমার সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন খেলেছি। মনে হয় না সমস্যা হবে।
প্রশ্ন : জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, এখনো শুরুটা ওমন হবে?
মাশরাফি : পাঁচ বছর আগে-পরের কথা নিশ্চয়ই এক নয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় এলে পজিটিভ বিষয়গুলো হয়তো কম হবে। তবে হেরে গেলে আলোচনা বেশি হবে। এমন না যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই শুরু করতে হবে। কয়েকদিন পর দল পাকিস্তানে যাবে। এ বছর আরও খেলা রয়েছে। প্রতিটি শুরুরই একটা প্রক্রিয়া আছে।
প্রশ্ন : নতুন করে প্রমাণ করবেন নিজেকে?
মাশরাফি : আমি গ্যারান্টি দিতে পারব না যে পারফরম করবই। তবে গ্যারান্টি দিতে পারব, আমি আমার শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করব। খেলোয়াড় হিসেবে এটাই মূল জায়গা। তবে টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে প্রশ্ন থাকতে পারে যে সে নিজের সেরাটা দিচ্ছে কি না। সেখানে প্রশ্ন থাকলে আমার মনে হয় ভালো করার প্রয়োজন আছে। পৃথিবীর কেউই গ্যারান্টি দিয়ে মাঠে নামতে পারে না যে সে পারফরম করবে। আগেও বলেছি এতদিন কাউকে প্রমাণ দিতে ক্রিকেট খেলিনি। নিজের চেষ্টায় খেলেছি।
প্রশ্ন : আপনাকে নিয়ে যে এত সমালোচনা হচ্ছে আত্মসম্মানবোধে আঘাত করছে কি না…
মাশরাফি : প্রথমত, আত্মসম্মান বা লজ্জা, আমি কি চুরি করি মাঠে? আমি কি চোর। খেলার সঙ্গে লজ্জা, আত্মসম্মান আমি মেলাতে পারি না। এত জায়গায় এত চুরি হচ্ছে তাদের লজ্জা নাই। আমি মাঠে এসে উইকেট না পেলে আমার লজ্জা লাগে। মানে উইকেট আমি নাই পেতে পারি আমার সমালোচনা করবেন, সমর্থকরা করবে। লজ্জা পেতে হবে কেন। আমি কি বাংলাদেশের হয়ে খেলছি না, অন্য কোনো দেশের হয়ে খেলছি যে আমার লজ্জা পেতে হবে। আমি পারিনি আমাকে বাদ দিয়ে দেবে, জিনিসটা তো সহজ।
প্রশ্ন : আপনার অবসরের বিষয়ে বেশি জলঘোলা হচ্ছে কি?
মাশরাফি : আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সবকিছু মিলিয়ে হয়তো পারফর্ম করিনি। জিনিসটা একটু জটিল জায়গায় আছে। এটা নিয়ে ভেবে তো আমি এখান থেকে বের হতে পারব না। আমি গ্যারান্টি দিয়েও বলতে পারব না আমি কালকে ৫ উইকেট পেয়ে সবকিছু শেষ করে দিলাম। একটা খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে একটা বয়স, একটা সময় আসে, প্রত্যেকটা দিনই তার জন্য চ্যালেঞ্জিং। আমি আসলে ওই সময়টায়ই আছি। আজ থেকে চার বছর পর তামিম, মুশফিক, রিয়াদ যারা আছে তাদেরও এ সময় আসবে। এটা কিন্তু একটা প্রক্রিয়াই, এটা নিয়ে এত কিছু ভাবনার আমি দেখি না।
প্রশ্ন : আসলে আপনি কবে অবসর নিতে চান, এমন কিছু ভেবেছেন?
মাশরাফি : থামলে তো জানবেন। বারবার একই প্রশ্ন করার কোনো মানে নেই (রেগে গিয়ে)। আপনারা কি কোনো জায়গায় আন ক্লিয়ার আছেন? একই প্রশ্ন বারবার করার কিছু নেই। বোর্ড থেকে যদি কিছু বলে বা আপনাদের যদি কিছু জানার থাকে… বোর্ডের সিদ্ধান্ত তো অবশ্যই আপনারা বোর্ড থেকে জানবেন। বোর্ড বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানাবে। আমার সঙ্গে যে আলোচনা হবে সেটা অবশ্যই পাপন ভাই বা বোর্ড সম্পৃক্ত যারা আছেন তাদের সঙ্গে হবে। এটা আপনাদের কাছে এসে বলার কিছু নেই। একই প্রশ্ন করছেন আপনি। আমার চাওয়া তো আপনাকে আমি আর বলব না। আমি ক্রিকেট বোর্ডকে জানাব, ক্রিকেট বোর্ড যদি চায় আপনাকে জানিয়ে দেবে।
প্রশ্ন : জিম্বাবুয়ে দলকে কেমন দেখছেন?
মাশরাফি : ছোট ফরম্যাটে জিম্বাবুয়ে বেশ শক্তিশালী। এ ফরম্যাটে তারা অনেক অভিজ্ঞ। অবশ্যই আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ এগোতে চাই। কাল শুরু করছি। এর পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ম্যাচে খেলব। এটা বলা মুশকিল আমরা তিন ম্যাচেই জয় পাব। তবে জয় দিয়েই শুরু করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।