ভিডিওতে দৃশ্য দেখে নিতান্তই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। অনুষ্ঠানটি ছিল বিখ্যাত ‘আমেরিকান আইডল’ মেধা প্রতিযোগিতার আদলে গঠিত মধ্যপ্রাচ্যের মেধা প্রতিযোগিতার জন্য খ্যাত ‘গ্লোবাল ট্যালেন্ট হান্ট’-এর আরব অনুচ্ছেদ (চ্যাপ্টার), যে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে একদল নবীন ফিলিস্তিনি কিশোর যুবক পেলেন ‘গোল্ডেন ট্যালেন্ট’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সনদ। অনুষ্ঠানটি গত বছর অনুষ্ঠিত হয় মিসরের কায়রো শহরে। এই খুদে ফিলিস্তিনি শিল্পীদলের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণটি নিজেই ছিল ইসরাইলের দখলদার বাহিনীর হানাদারি ও অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলমান গণযুদ্ধের একটি দুঃসাহসী অভিযান।
প্রথম চ্যালেঞ্জটি ছিল বন্দিশিবির ও বিভিন্ন অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি জনপদ থেকে প্রতিযোগীদের কড়া ইসরাইলি সেনা প্রহরা ভেদ করে একত্রিত হওয়া। দ্বিতীয়, জীবন-মরণ চ্যালেঞ্জটি ছিল চার চারটি সামরিক চেকপোস্ট ডিঙিয়ে জীবন বাজি রেখে গাজা ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে এসে সহিসালামতে কায়রো পর্যন্ত পৌঁছানো। তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিল আয়োজক ও আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলীর সামনে মঞ্চে উঠে ফিলিস্তিনি ক্ষুদে বাদন দলটির মেধা প্রকাশের উপস্থাপনা। এরা গাইল, আবৃত্তি করল এবং আধুনিক র্যাপ সঙ্গীতের মাধ্যমে দর্শক ও বিচারকদের সামনে ফিলিস্তিনের কান্না তুলে ধরল।
পরিবেশন শেষে যখন হলভর্তি দর্শক ও বিচারকরা প্রশংসা ও অনুপ্রেরণায় উচ্ছ¡সিত এবং মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে হলের মাইকের শব্দও ঢাকা পড়ার মতো অবস্থা, তখন এই কিশোর তরুণ ফিলিস্তিনিরা ডুকরে কেঁদে উঠল। প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়ে প্রতিযোগীরা আনন্দে উথলে ওঠে, কাঁদলেও সে কান্নাটি হয় আনন্দের। তারা কাঁদতে থাকল তাদের ওপর প্রায় ৭৫ বছর ধরে অর্থাৎ তিন পুরুষ ধরে ইসরাইলের হানাদারি, নির্বিচার গণহত্যা, গুম, জেল, কারাভোগ এবং ঘর ছাড়ার বাঁধভাঙা বেদনা প্রকাশে। এই দলের সর্বকনিষ্ঠ বেজ-গিটারিস্টের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। চোখের পানিতে ভিজে গেল তার গিটার, কারো কি-বোর্ড, কারো ড্র্রাম, কারো অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। মুহূর্তের মধ্যে হলের নিস্তব্ধতা আর তাদের নীরব রোনাজারি যেন একাকার হয়ে গেল।
তারা যখন গাইছিল তাদের গান, বাজাচ্ছিল তাদের বাদ্যযন্ত্র, ড্রামে তুলছিল ভরাট নিনাদ, সুর তুলছিল বেহালার মতো দেখতে ঐতিহ্যবাহী আরব বাদ্যযন্ত্রে কিংবা আড়বাঁশিতে, তখন পরিবেশটা মনে হচ্ছিল ঠিক যেন এ গান পরিবেশিত হচ্ছে পশ্চিম তীরে, গাজায়, নাবলুসে বা হেবরনের ধ্বংসস্ত‚পে কিংবা কোনো ফিলিস্তিনি শহরের উপকণ্ঠে গোরস্তানগামী লাশের মিছিলে। মনে হচ্ছিল সেই আরব বাদ্য ঝঙ্কার যেন পুণ্যনগরী জেরুসালেম শহরের প্রস্তর-প্রাচীরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সেই সুর লয়ে ‘হেবরনের পাহাড়গুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে/আর গোলানের ঊষর মরুর বালুকার আস্তরগুলো থেকে জরির প্রতিবিম্ব ছড়াচ্ছে/রকেট, গোলা আর রাইফেলের গুলি যেন সে গানের মুখরা, মর্টারগুলো যে গানের সঞ্চারি/শাহাদতের অনিবার্যতা যে গানের অন্তরা…।’ এই সেই ফিলিস্তিনি আরব ক্রন্দন সঙ্গীত! ‘যে গানে ডুকরে কেঁদে উঠছিল জলপাই বীথিকা, যার সুরে আন্দোলিত হচ্ছে জয়তুনের শাখা আর প্রস্তরে বিন্যস্ত গিরিগুহায় হানাদারদের লৌহ কাঁটাতারের প্রহরা বেষ্টনী।’ প্রতিদিন বিশ্ব সংবাদে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের ওপর তথা গোটা ফিলিস্তিনি জাতির ওপর দখলদার ইসরাইলিদের যে নৃশংসতার দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এদিনের এই ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে আরব বালকদের ক্রন্দনগীতি (Lore) যেন তারই একটি ‘কোলাজ’ তুলে ধরল মিসরি তথা বিশ্ববাসীর সামনে।
সংস্কৃতি ফিলিস্তিনি আরবদের একটি বংশগত ঐতিহ্য। মরু-বাদ্য, লোকনৃত্য, উচ্চমানের গীতি ও কাব্য এই মহতি সংস্কৃতিরই একটি বাহন। এটি এই ঐতিহাসিক জনপদের আরব মুসলিম, দ্রুজ খ্রিষ্টান, পারসিক, আর্মেনিয়ান, সিরকাসিয়ান- সব ধর্মাবলম্বী মানুষেরই অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যা বিশ্ব সাহিত্যেও অনিবার্য অনুষদ মহান আরব্য সংস্কৃতিরই ধারক ও বাহক। সেই ধারাতেই অবগাহন করে চলেছে আরব্য সঙ্গীত ও বাদনরীতি।
আরবদের বৈচিত্র্যময় গীতিকাব্য ও গায়কী ধারাই বহুজাতিক ফিলিস্তিনি কবিতা ও সঙ্গীতের সম্ভারে। সমকালীন আরব কবিরা ঐতিহ্যবাহী আরব্য সাহিত্যেও মহান উত্তরাধিকার নিয়ে আরো সমৃদ্ধ হয়েছেন। এদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের বহু ফিলিস্তিনি কবিতা বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যের আসরকে সমৃদ্ধ করছে। সম্প্রতি আমেরিকার খ্যাতনামা সাহিত্য সাময়িকী ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকা ছাপতে না পেরে বা বাধ্য হয়ে বিবেচনা না করে অনুশোচনা করেছে, ফিলিস্তিনি কবি ফাদি হুদার সেই কাব্যে বলা ছিল, ‘যে তুমি আমায় আমার পিতৃভিটে থেকে উচ্ছেদ করলে/সেই তুমিই তো তোমার অতীতের প্রতি অজ্ঞতা দেখালে। /তাই তুমি অন্ধ চোখে দেখো না কিছুই/এমনকি তোমার আগামী বংশধরদের কথাও ভাবো না।/অথচ তোমার অতীত সব সময় তোমার সাথে সাথে চলেছে।/সে চলেছে নিত্য বর্তমান হয়ে;/তুমি তো আর গর্দভ নও যে, শুধু বহন করেই যাবে তোমার পিঠের জঞ্জালের বোঝা!
ফাদি হুদার আগের ও পরের প্রজন্মেও অজস্র কবি আছেন ফিলিস্তিনে, যাদের লেখা মধ্যপ্রাচ্যেও মরু উপত্যকা ডিঙ্গিয়ে লন্ডন, প্যারিস, অটোয়া, বন, টোকিও, নিউ ইয়র্কের কাব্যভুবনে ইতোমধ্যেই ঠাঁই করে নিয়েছে। যাদের মধ্যে যে নামগুলো না নিলেই নয়, তারা হলেন মাহমুদ দারবিশ, তামিম আল ভারগোতি, গিয়াস আল মাহুন, সামি আল কাসিম, ফাদ ওয়া তুফান, ফারাহ সাম্মা, ঘাসান জাকতান, ইব্রাহিম আল-তুহফান, সালমা আল জাওমি, মায়া আল আল-হায়াৎ, নাথালি হান্দাল, মোহাম্মদ আল করিম, হান্না আবু হান্না, মুসা আল হামদাহ, ইউসুফ নাভানি, ইলিয়াস মানবার, দাউদ তুর্কি, তাওফিক আল জিয়াদ, মুস্তাফা আল সাইকি, রাফি জাদেহ, হিসাব আল জিরিক, নওয়াজান দারয়িশ, ইমান কুতাহ, নাদাহ ওসমান, আহমেদ আহমেদ যাতায়াহ, ফুয়াদ নাইম, এ্যাডমান্ড শাহেদা, হিন্দ সাওফানি, সুলাইমান আল তাজি প্রমুখ। যেকোনো দেশের বিপ্লব বা যুদ্ধের সময় জনগণের পক্ষ নিয়ে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীসমাজ এগিয়ে আসে। ফিলিস্তিনেও তার ব্যত্যয় হয়নি; বরং দখলদার ইসরাইলের আরব খুনের নেশা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদই কবিতায়, গানে, চিত্রাঙ্কনে ফুটে উঠছে। প্রায়ই সেই সব কবিতা বা সৃজনশীল কর্ম বিশ্বাঙ্গনে সাড়া জাগাচ্ছে এবং মহত্বও শিল্প আকারে নন্দিত হচ্ছে।
পুরো ফিলিস্তিনে এখন ১১৫টিরও মতো শুধু ‘পপ মিউজিক ট্রুপ’ বা আধুনিক সঙ্গীত দল আছে। আরো রয়েছে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক দল, যাদের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। এ যেন নজরুলের সেই, ‘এক হাতে মম বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য!’ আশ্চর্যের ব্যাপার, এদের গড় বয়স ১৫ বছর। একটু প্রবীণ যারা, তারা মেতে আছেন আরব বাদন, মরু নৃত্য ও পল্লীগীতি নিয়ে। সেই ঐতিহ্যবাহী ধারাতেও সংযুক্ত হয়েছে আরব প্রতিরোধ সংগ্রামের দেশাত্মবোধক চেতনা। ওই ঘরানার শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় তারকাদের তালিকায় আছেন জোয়ান সাফাসি, মোহাম্মদ আসফ, তামির নফর, সাদিয়া মানসুর, মিনা মাকাউল, ক্যামেলিয়া জুরান, এলিয়ানা তায়েফ, জালাম আবু আমানাহ্, বাশার মুরাদ, রিমা কেলানি, লায়লা বেগ ওয়াল গ্রেইন, আবু বেইলি, আবু আল ফারসি, আমর আল হাসান, ইয়াকুব শাহীন, তারামিক নজর, হিশাম সোমালি, নাবিল সালামেহ, ফাদি আনদ্রাওয়াস, আমাল মারকুস, টনি কাত্তান প্রমুখ। এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো নাম করা আরব সঙ্গীত পরিচালকের শিষ্য-ভক্ত। এদের মধ্যে আরব মুসলমান ছাড়াও আছেন খ্রিষ্টান দ্রুজ ও অন্যান্য আরব গোত্রের মানুষ। এই প্রতিবাদী ও সংগ্রামী ফিলিস্তিনির প্রতি নৈতিক সমর্থনকারী ইসরাইলি কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যাও কম নয়। এদের মধ্যে অনেকে অধিকৃত আরব ভূখণ্ডের বাসিন্দা, অন্যরা ইসরাইলের মূল ভূখণ্ডের। ইসরাইলে গণতন্ত্র আছে। তাই তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ, এমনকি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনেরও অধিকার রাখে।
ফিলিস্তিনিদের দাবি এত যুক্তিসঙ্গত এবং সঠিক যে, বিবেকবান ইসরাইলিদের অনেকেই আছেন, যারা নৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকেন ফিলিস্তিনিদের প্রতি। এদের মধ্যে বিচারপতি, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, খেলোয়াড়, শ্রমিক নেতা, মানবাধিকারকর্মী আছেন। এদের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাই বেশি। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি ইউরোপের জনগণেরও আছে। নেই শুধু আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামের শাসকদের। এসব দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা, শিল্প-বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের মালিক-মোক্তার হচ্ছে ইহুদিরাই। ইসরাইলের প্রতি পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার হেতু এটিই। ফিলিস্তিনিদের প্রতি নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেছে বিশ্বের নামকরা ফুটবল তারকাদের মধ্যে লিভারপুলের মোহাম্মদ সালাহ, ম্যানচেস্টার সিটির মেরোজ, ফ্রেঞ্চ ফুটবলার ফ্র্যাংক রিভারি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পল পোগবা, চিলির প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলাররা প্রমুখ।
ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে সম্প্রতি আরো একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। জগতের ১০০ জন নিজ নিজ ক্ষেত্রের বিশেষক বুদ্ধিজীবী ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে অধিকৃত পশ্চিম তীরে এসে জড়ো হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশ্বের খ্যাতিমান এই ১০০ জন বুদ্ধিজীবীর ফিলিস্তিন সফরের আয়োজন করছে ইউরোপভিত্তিক তিনটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা। এই ১০০ বুদ্ধিজীবীর বেশির ভাগই অনারব ও অমুসলিম। এরা আরব উপত্যকায় মানবতার বধ্যভূমির কান্নার সমব্যথী এবং আরব ফিলিস্তিনিদের গান ও কবিতায় মৃত্যু উপত্যকার রোনাজারি তাদের হৃদয়ে তার সাড়া পড়েছে। ঠিক এ রকমই এক আধুনিক ফিলিস্তিনি কবি ফাদওয়ার তুফানের লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা- যার শিরোনাম ছিল: ‘জেরুসালেমের নিকুঞ্জে পবিত্র একটি ফুল।’ সেই কবিতা ইতোমধ্যে ১৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ঠাঁই করে নিয়েছে সমসাময়িক বিশ্ব সাহিত্যে:
জেরুসালেমের নিকুঞ্জে পবিত্র একটি ফুল
ফাদওয়ার তুফান
এই তো আমার জন্য যথেষ্ট!
জন্মেছি এই মাটিতে;
মরবও এই মাটিতেই।
গলে মিশে যাব এই মৃত্তিকায়।
তারপর বিকশিত হবো ফুল হয়ে,
এ দেশের মানুষের সঙ্গী হবো।
তবে হায় কোথায় শান্তি
এই দখলকৃত দেশে?
তবু এ দেশকে আমি বুকে জড়িয়ে রাখব।
এ আমার জন্মভিটে পবিত্র
জেরুসালেম, আমার জীবনে, মরণেও।
এ আমার ফিলিস্তিন,
আমার গর্বের নিকেতন।
এ দেশের ধুলায় হবে আমার শেষ ঠাঁই।
আমার জীবনের শুরু এবং শেষ।
এক গোছা দূর্বাঘাস হয়ে আমি ফের জন্মাব,
যুগ-যুগান্তর ধরে, এই স্মৃতিচক্রের
পালা ধরেই।
জেরুসালেমের পবিত্র নিকুঞ্জে
একটি ফুল হয়ে ওঠা, এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট!