দীর্ঘ দিন ধরেই দেশের রাজনীতি নানামুখী সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এ সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার জন্য ক্ষমতাসীন দলের যেমন কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনো উত্তাপ নেই রাজনৈতিক অঙ্গনেও।
সংসদে বিরোধী দল বলে যে কিছু আছে, সেটি যেমন টের পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি জনপ্রিয়তার দিক থেকে মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিতি বিএনপির অবস্থাও নাজুক। দলটির সমর্থকের কোনো অভাব নেই। কিন্তু এই সমর্থনকে শক্তিতে রূপান্তরের কোনো প্রচেষ্টা আছে বলে কেউ মনে করছেন না।
বিএনপির নেতৃত্ব বেশ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক দিকে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাবন্দী, অন্য দিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাধ্য হচ্ছেন দেশের বাইরে থাকতে। এর পাশাপাশি ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় মামলা-হামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীদের সামনে এখন কোনো আলোর রেখা নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা হতাশ কিংবা নিষ্ক্রিয়।
এরকম অবস্থায় টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হয়ে দেশ পরিচালনা করছে। আপাত দৃষ্টিতে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষ তাদের নেই। রাজপথও কণ্টকাকীর্ণ নয়। ‘অর্থনৈতিক সঙ্কট’ চলছে, এমন কথাও সরকার মানতে নারাজ। সে ক্ষেত্রে তাদের সুসময়ের কোনো হেরফের হয়নি, বলাই যায়। মুজিববর্ষে সেই প্রতিফলন ঘটাতে জমকালো আয়োজনও চলছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ধারণা করা হচ্ছিল, দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ লেগেই থাকবে। এর কারণ বিতর্কিত ওই নির্বাচনে সরকারি দলের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি জোটের মাত্র সাতটি আসন প্রাপ্তি। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি জোটের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। দলটি একটি হরতাল ডাকতেও রাজি হয়নি।
নির্বাচন পরবর্তী এক বছর বলতে গেলে এ ইস্যুতে শক্ত কোনো কর্মসূচি ছাড়াই কাটিয়েছে বিএনপি। এর একটি বড় কারণ ছিল বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকা। দলটির নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে দৌঁড়ঝাঁপ করেছেন। আদালতে গেছেন বারবার। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বিএনপির নেতারা বেগম জিয়ার মুক্তির ইস্যুটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় মনে করলেও এ দাবিতে রাজপথে জোরালো কোনো কর্মসূচি তারা দেননি। দলটির অভ্যন্তরে এটা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
কিন্তু নীতিনির্ধারকরা কোনো ‘হঠকারী’ পথে যেতে চান না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেই তাদের ভরসা। সেই ভরসা থেকে বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে থেমে থেমে নানা ‘নিরীহ’ কর্মসূচি চলছে। দ্বিতীয়বারের মতো বেগম জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা আরও বেড়ে গেছে। তারা জোরালো কর্মসূচি আশা করছেন, কিন্তু কেন্দ্র থেকে তা পাচ্ছেন না। দলের ভেতরে কেউ কেউ বলছেন, ‘বিএনপির নেতৃত্ব ডিফেন্সিভ খেলতে খেলতে গোল করা ভুলে গেছে।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল এ সরকারের অধীনে তারা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না, সংসদেও যাবে না। কিন্তু দলটি শেষ পর্যন্ত এ দু’টি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। এখন সব নির্বাচনেই অংশ নিচ্ছে। ঢাকা সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি আবারো হতাশ হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এতে। ভোট হচ্ছে, ভোটার নেই। ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আছে, বিএনপি নেই। শিগগিরই আরও কয়েকটি ভোটে অংশ নিতে যাচ্ছে বিএনপি। সেখানেও যে ভোটচিত্রের কোনো পরিবর্তন হবে, তা কেউ ভাবতে পারছে না।
এসব নির্বাচন নিয়ে টিআইবিসহ নিরপেক্ষ অনেক সংস্থারও প্রশ্ন রয়েছে। তারাও নির্বাচনীব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে মতামত দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দেশে নির্বাচন আছে ঠিকই, কিন্তু কোনো আমেজ নেই। রাজনৈতিক উত্তাপ নেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। যে নির্বাচন হচ্ছে, তা অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না। বিরোধী কেউ জিততে পারবে না, এমন নির্বাচন চলছে। এটি একটি পাতানো খেলা।
তিনি বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ক্ষমতা রদবদলের গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
চলতি বছরে বিএনপির পক্ষে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলেই অনেকে মনে করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে এ বছরের রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। আসছে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূর্তির মুহূর্ত থেকে শুরু হচ্ছে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। চলবে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের কাউন্ট ডাউন বা ণগণনা শুরু হয়ে গেছে গত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস থেকেই। এ উপলে বছরজুড়ে সরকারি ও দলীয়ভাবে নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। নতুন বছরে সব ধরনের অস্থিরতা এড়াতে সরকার আরও কঠোর অবস্থান নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মুজিববর্ষে তাই বিরোধীদের রাজপথে কঠিন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মুজিববর্ষ পালনের পাশাপাশি ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
এক দিকে মুজিববর্ষ পালন এবং অন্য দিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সিরিজ কর্মসূচির ফাঁকে ‘গণতন্ত্র উদ্ধার’ কিংবা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে বিরোধীদের জন্য আলাদা সঙ্ঘবদ্ধ কর্মসূচি পালন কঠিন হবে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেরা বলছেন।
তবে প্রথাগত রাজনীতির অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে নানা গুজব তথ্য আকারে ভেসে বেড়ায়। অবশ্য এসব গুজব কতটা সত্য বা কতটা মিথ্যা তা যাচাই করা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রাজনীতির স্বাভাবিক পথচলার ব্যত্যয় ঘটলে, বিকল্প কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটা অস্বাভাবিক নয়।