রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৬ পূর্বাহ্ন

কাবার পথের মেহমান

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩
  • ৬৩ বার

হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা স্তম্ভ। আরবি ভাষায় হজ শব্দের অর্থ জিয়ারতের সঙ্কল্প করা। যেহেতু খানায়ে কাবা জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা পৃথিবীর চার দিক থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে চলে আসে, তাই এর নাম হজ রাখা হয়েছে। কিন্তু এ হজের পেছনে এক সংগ্রামী, চিত্তাকর্ষক ও শিক্ষাপ্রদ ইতিহাস নিহিত রয়েছে। যারা এ বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্রে আল্লাহর মেহমান হিসেবে হাজিরা দিতে যাবেন, তারা যদি একটু গভীর মনোযোগসহকারে সে ইতিহাস অধ্যয়ন করে নেন তবে হজের প্রকৃত শিক্ষা ও কল্যাণ লাভ করা সহজ হবে।

হজ এলেই আমাদের হৃদয়স্পটে ভেসে ওঠে শিরকের মূলোৎপাটনকারী মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা ও পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর কথা। যিনি মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রভুর সন্ধানে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্রকে ব্যর্থ প্রভু ভেবে ভেবে অবশেষে সত্যের আলোর সন্ধান পেলেন এবং উদাত্ত কষ্ঠে ঘোষণা করলেন- ‘তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরিক বলে মনে করো তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশেষভাবে কেবল সেই মহান সত্তাকেই ইবাদত-বন্দেগির জন্য নির্র্দিষ্ট করলাম, যিনি সব আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নই।’
এ পূর্ণাঙ্গ মানুষটি যৌবনের শুরুতেই যখন আল্লাহকে চিনতে পারলেন তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে বললেন- ‘ইসলাম গ্রহণ করো- স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করো, আমার দাসত্ব স্বীকার করো। তিনি উত্তরে পরিষ্কার ভাষায় বললেন- আমি ইসলাম কবুল করলাম, আমি সারা জাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করলাম, নিজেকে তার কাছে সোপর্দ করলাম। তিনি রাব্বুল আলামিনের জন্য শত শত বছরের পৈতৃক ধর্ম এবং এর যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান ও আকিদা বিশ্বাস পরিত্যাগ করলেন। অথচ পৈতৃক মন্দিরের পৌরহিত্যের মহাসম্মানিত গদি তার জন্য অপেক্ষা করছিল।

যে গদিটিতে বসলে তিনি অনায়াসেই জাতির নেতা বনে যেতেন। চার দিক থেকে নজর-নিয়াজ এসে জড়ো হতো এবং জনগণ ভক্তি -শ্রদ্ধাভরে মাথা নত ও হাত জোড় করে বসত। সাধারণ মানুষ থেকে বাদশাহ পর্যন্ত সবাইকে আজ্ঞানুবর্তী গোলাম বানিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু এ বিরাট স্বার্থের ওপর পদাঘাত করে সত্যের জন্য দুনিয়াজোড়া বিপদের গর্ভে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হলেন। জন্মভূমি থেকে বের হয়ে আরব দেশসমূহে ঘুরতে লাগলেন। এ ভ্রমণে তার ওপর অসংখ্য বিপদ এসেছে। রাত-দিন তিনি কেবল একটি চিন্তা করতেন, দুনিয়ার মানুষকে অসংখ্য রবের গোলামির নাগপাশ থেকে মুক্ত করে কিভাবে এক আল্লাহর বান্দায় পরিণত করা যায়। দেশ ত্যাগ ও নির্বাসনের দুঃখ-কষ্ট ভোগ করার পর বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাঁকে সন্তান দান করলেন। তিনি তার জন্যও একই ধর্ম ও কর্তব্য ঠিক করলেন। সব কঠিন পরীক্ষায় পাস করার পর চূড়ান্ত ও শেষ কঠিন পরীক্ষা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হজরত ইবরাহিম আ: সব কিছু অপেক্ষা রাব্বুল আলামিনকেই বেশি ভালোবাসেন কি না, তার ফয়সালা হতে পারত না। তাই বৃদ্ধ বয়সে একেবারে নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর তার সন্তান লাভ হয়েছিল সে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করতে পারেন কি না তারই পরীক্ষা নেয়া হলো। পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন। তখন চূড়ান্তরূপে ঘোষণা করা হলো যে, এখন তুমি প্রকৃত মুসলিম হওয়ার দাবিকে সত্য বলে প্রমাণ করেছ। এক্ষণে তোমাকে সারা পৃথিবীর ইমাম বা নেতা বানানো যায়। আল-কুরআনে বলা হয়েছে- ‘এবং যখন ইবরাহিমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় ঠিকভাবে উত্তীর্ণ হলেন তখন তাকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের ইমাম বা নেতা নিযুক্ত করছি। তিনি বললেন, আমার বংশধরদের সম্পর্কে কী হুকুম? আল্লাহ তায়ালা বললেন, জালেমদের জন্য আমার ওয়াদা প্রযোজ্য নয়’ (সূরা বাকারা-১২৪)।

এভাবে হজরত ইবরাহিম আ:-কে দুনিয়ার নেতৃত্ব দান করা হলো এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম বা মুসলমানদের চিরস্থায়ী আদর্শিক নেতা নিযুক্ত করা হলো। জ্যেষ্ঠ পুত্র হজরত ইসমাইল আ:-কে সাথে নিয়ে তিনি মক্কা নগরীকে কেন্দ্র করে আরবের কোণে কোণে ইসলামের শিক্ষাকে বিস্তার সাধন করলেন। আর পিতা-পুত্র মিলে ইসলামী আন্দোলনের বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্র খানায়ে কাবা প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এ কেন্দ্র নির্দিষ্ট করে দেন। খানায়ে কাবা সাধারণ মসজিদের মতো নিছক ইবাদতের স্থান নয়, প্রথম দিন থেকেই এটি দ্বীন ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রচার কেন্দ্ররূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ কাবা নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী সব মানুষ এখানে এসে মিলিত হবে এবং সঙ্ঘবদ্ধভাবে এক

আল্লাহর ইবাদত করবে, আবার এখান থেকে ইসলামের বিপ্লবী পয়গাম নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। বিশ্ব মুসলিমের এ সম্মেলনেরই নাম হজ।
এ ঘরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়া শুনুন : আল-কুরআনে আল্লাহ বলছেন- ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম দোয়া করেছিলেন- হে আল্লাহ! এ শহরকে শান্তিপূর্ণ বানাও, আমাকে এবং আমার সন্তানকে মূর্তিপূজার শিরক থেকে বাঁচাও। হে আল্লাহ! এ মূর্তিগুলো অসংখ্য লোককে গোমরাহ করেছে। অতএব, যে আমার পন্থা অনুসরণ করবে সে আমার, আর যে আমার পন্থার বিপরীতে চলবে- তখন তুমি নিশ্চয়ই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরওয়ারদিগার! আমি আমার বংশধরদের একটি অংশ তোমার এ মহান ঘরের কাছে, এ ধূসর মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেছি- এ উদ্দেশ্যে যে, তারা সালাত কায়েম করবে। অতএব, হে আল্লাহ! তুমি লোকদের মনে এত দূর উৎসাহ দাও যেন তারা এর দিকে দলে দলে চলে আসে এবং ফল-মূল দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করো। হয়তো এরা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবে’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৫-৩৭)।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিমের জন্য এ ঘরের স্থান ঠিক করেছিলাম, এ কথা বলে যে, এখানে কোনো প্রকার শিরক করো না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও নামাজিদের জন্য পাক-সাফ করে রাখো। আর লোকদেরকে হজ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহ্বান জানাও- তারা যেন তোমার কাছে আসে, হেঁটে আসুক কিংবা দূরবর্তী স্থান থেকে কৃশ উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের ব্যবস্থা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেয়া জন্তুগুলোকে আল্লাহর নামে কোরবানি করবে, তা হতে নিজেরাও খাবে এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরকে খেতে দেবে’ (সূরা হজ : ২৬-২৮) (আগামীকাল সমাপ্য)।

লেখক :

  • জাফর আহমাদ

শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com