বিজেপির রাজনীতি যে সম্প্রদায়বাদী, অন্তত দলীয় বিচারে তা অস্বীকারের উপায় নেই। তাদের আদর্শিক ক্ষেত্রটি ওই ধারারই প্রেরণাদায়ক। হিন্দু মহাসভা, আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ), এমনকি শিবসেনা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হিন্দুত্ববাদী আদর্শের হাল ধরে তারা স্বাধীনতা-উত্তর প্রাথমিক যুগের বহুত্ববাদী ভারতকে হিন্দুত্ববাদী ভারতে পরিণত করতে চাইছে। আরো সাদামাটা ভাষায় ‘হিন্দুরাষ্ট্র ভারত’। বাজপেয়ির পর থেকে সরকারি পর্যায়ে এ চেষ্টা এখন খুব স্পষ্ট।
মুখে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা, রামমন্দির নির্মাণ তার রাজনৈতিক প্রতীক। প্রসংগত উল্লেখ্য যে এ হিন্দুরাষ্ট্র গান্ধীজির রামরাজ্য নয়—যেখানে গীত ‘ঈশ্বর-আল্লা-তেরে নাম’। তবু ধর্মীয় রাজনীতি যে গণতন্ত্রের বিপরীত ঘরানার ও ভিন্ন চরিত্রের এবং গণতন্ত্রীর জন্য একান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত বিজেপি শাসিত ভারত প্রতিপদে তার প্রমাণ দিচ্ছে। গান্ধীজির রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় সে সম্ভাবনা ধরা পড়েনি।
প্রমাণ মিলেছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সদস্য নাথুরাম গডেসর গুলিতে গান্ধী হত্যার মাধ্যমে। কিছু ঘটনার অনুষঙ্গ আমাদের ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করে, অবাক করে না। ওই হত্যার নেপথ্য কারণ ভারতে, বিশেষত দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে এবং প্রতিবাদে গান্ধীজির অনশন। গান্ধীশিষ্য সম্প্রদায়বাদী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি দিল্লির একপেশে দাঙ্গার নীরব দর্শক গুরুর আহ্বান সত্ত্বেও। লৌহমানব নামের মহিমাদীপ্ত প্যাটেল মহাশক্তিমান, প্রচলিত জল্পনায় নমনীয় চরিত্রের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর চেয়েও শক্তিমান বলে কথিত। একাধিক ঘটনায় তার প্রমাণ মিলবে।
সেই প্যাটেলের পূর্ণদৈর্ঘ্য মূর্তি বিজেপি তথা মোদি-অমিত শাহদের রাজনৈতিক প্রেরণা। আর সে জন্যই কী দিল্লি জ্বলছে, মানুষ মরছে। নাগরিক সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদী আন্দোলন অংশত হলেও জনসমর্থন পেয়ে গোটা ভারতকে উত্তাল-অশান্ত করে তুলেছিল এবং শুরুতে নীরব, নিষ্ক্রিয় মোদি-শাহ। এবং পুলিশ বাহিনী।
উভয় ঘটনার মিল এখানে যে বিক্ষুব্ধ ভারতকে সামাল দিতে না পেরে মোদি-শাহর বিজেপির ক্যাডার বাহিনী যখন সরকারি মদদে রাজপথে নামে, আন্দোলন থামাতে আক্রমণ চালায়, সেক্যুলার আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক চরিত্রে পরিণত করার পর যথারীতি পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা—রাজনীতির বহুলছাট উদাহরণের প্রকাশ ঘটিয়ে।
দুই.
একালে কোনো নব্য গান্ধীর আবির্ভাব ঘটেনি, তিনি অনশনব্রত নিয়ে নিয়মিত প্রার্থনা সভায় সম্প্রীতির আহ্বানও জানাচ্ছেন না। বলছেন না যে তাঁর আমরণ অনশন চলবে যত দিন দাঙ্গা বন্ধ না হয়, যে জন্য তাঁকে হত্যা করতে হলো। গুরুর মৃত্যুর নেপথ্যে শিষ্য প্যাটেলের নিষ্ক্রিয়তা।
প্রতিবাদী গান্ধী নেই। কিন্তু সরকারি নীতির প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নানা ঘরানার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কবি-শিল্পী-অভিনেতা-রাজনীতিক-কূটনীতিক-বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী ব্যক্তিত্ব। চলছে প্রতিবাদ রাজ্য থেকে রাজ্যে। কাজেই নামাতে হলো গেরুয়া ক্যাডার বাহিনী গোটা ঘটনার চরিত্র বদল ঘটাতে, একে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে। দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন একপর্যায়ে কেন্দ্রীভূত হলো রাজধানী দিল্লিতে।
এরই মধ্যে ঘটে গেছে অন্য এক বিপর্যয়। দিল্লির নির্বাচনে কেজরিওয়ালের কাছে বিজেপির ভরাডুবি। হতাশাগ্রস্ত পার্টি ক্যাডারদের চাঙ্গা করতে দরকার হাত রক্তরঞ্জিত করা। তাই দিল্লিতে সহিংস সংঘাত। পূর্ব ঘটনামাফিক দিল্লি পুলিশ নিষ্ক্রিয়, ঘটনার নীরব দর্শক। সরকারি মদদে শক্তিমানদের খেলতে দিচ্ছে তারা। যেমন দিয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলের পুলিশ বাহিনী। প্যাটেল-শিষ্য মোদি-অমিত শাহর নির্দেশে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সময়ের ব্যবধান যদিও সাত দশক, তবু কুটিল রাজনীতি একই পথ ধরে চলে, রণনীতি-রণকৌশলের মধ্যে। পার্থক্য নেই। এসব ক্ষেত্রে থাকে না।
এই অগ্নিগর্ভ অবস্থা, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে আরেক সম্প্রদায়বাদী (সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী), যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই দিনের দিল্লি সফর। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইতিপূর্বেকার নীরবতা ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শান্তির বারি বর্ষণের মতো করে উপদেশ বাণী—‘শান্ত থাক, সম্প্রীতি বজায় রাখ।’ ট্রাম্প শুনলেন সে বাণী।
এর তাৎপর্য বুঝে হোক, না বুঝে হোক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে শান্তিস্বরূপ একাধিক প্রশংসাবাক্যে সিক্ত করলেন। একবারও ভাবেননি রক্তাক্ত দিল্লি, নিহত ২৭, এ সংঘাত দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা কি অসম্ভব ছিল? আসলে হত্যায়ই বোধ হয় তৃপ্তি যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। তাই তাঁর পক্ষে যথাযথ প্রতিক্রিয়া।
তিন.
পাঠক ভাবতে পারেন, যুক্তিহীনভাবে দিল্লি সহিংসতার দায় ক্ষমতাসীন দুই নবীন লৌহমানবের ওপর চাপাচ্ছি। একজন বাহিরঙ্গে এতটা নমনীয় ও শান্তিবাদী যে তাঁর তল খুঁজে পাওয়া যায় না, যদিও গুজরাটকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক হিসেবে তাঁর কুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা যে তা সত্ত্বেও তিনি জনপ্রিয় এবং বিপুল ভোটে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী। তবে দ্বিতীয়জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সত্যি লৌহমানব, তিনি প্যাটেলের যোগ্য শিষ্য হয়েও অধিকতর গুণান্বিত। তিনি তাঁর মতাদর্শের নির্মমতায় প্রকাশ্যেই হিমালয়সম অটলতার প্রতীক এবং স্পষ্টভাষী, প্রধানমন্ত্রীর বিপরীত স্বভাববৈশিষ্ট্যে। দুজনে মিলে একে অন্যের পরিপূরক, বিজেপির জন্য আদর্শ জুটি।
দিল্লি সহিংসতার দায় ওই জুটির ওপর চাপিয়েছেন সুধীন্দ্র কুলকার্নি। এই ভারতীয় রাজনীতিকের বক্তব্যের ঢাকাই কাগজের শিরোনাম : ‘দিল্লি সহিংসতার দায় মোদি-অমিত জুটির’। কুলকার্নি দিল্লি দাঙায় পূর্ব ঐতিহ্যমাফিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততারই সমালোচনা করেননি, ভূমিকা যে ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য প্রতিকূল তাও বলেছেন।
তাঁর মতে দিল্লিতে আম-আদমি পার্টির কাছে বিজেপির পরাজয়ের প্রতিশোধস্পৃহা থেকে এই সাম্প্রদায়িক দাঙার সূত্রপাত, যদি এ সুযোগে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে কেজরিওয়ালকে হটানো যায়। একই ধরনের মতামত প্রকাশ পেয়েছে কলকাতা থেকে পাঠানো সৌমিত্র দস্তিদারের বক্তব্যে। শিরোনাম : ‘দিল্লিতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একচেটিয়া দাঙ্গা’।
এরই মধ্যে দাঙ্গায় নিহতদের পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টাও চলছে, সংবাদপত্রের শিরোনাম তাই বলছে। এই দাঙ্গা যে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক তা দিল্লি ও কলকাতার বেশির ভাগ সাংবাদিকের লেখায় তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। নিহতের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৩০, আহত কয়েক শ। উপমহাদেশে রাজনীতিকদের তুরুপের তাস যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—সেই পুরনো ঐতিহ্যকে নতুন করে আবার প্রমাণ করল মোদি-অমিত শাহ সরকার।
এ দাঙ্গায় মোদির শাসনামলে গুজরাটে সংঘটিত একপেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিরূপ দেখতে পাচ্ছেন কোনো কোনো সংবাদবিশ্লেষক ভারতীয় সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের কেউ কেউ। এতে তাঁরা দেশের জন্য অশুভ সংকেতও প্রত্যক্ষ করছেন।
কারো মতে এতে ভারতীয় গণতন্ত্রের বিপন্নদশা প্রতিফলিত। আমার তো মনে হয় বিজেপির দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনে ভারতীয় গণতন্ত্রের মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনিই বাজতে শুরু করেছে।
বিজেপির শীর্ষ নেতারা, বিশেষ করে মোদি-অমিত জুটি যে মাত্রায় বেপরোয়া তাতে ভারতে হিন্দুত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন না করা অবধি তাঁদের মনে শান্তি আসবে না।
তাতে যত প্রাণ বলিদান হোক তাঁদের যায় আসে না। বিবিসির এক বিশ্লেষণেও বলা হয়েছে, ‘গুজরাট দাঙ্গার প্রতিধ্বনি শোনা যায় দিল্লির সংঘর্ষে’।
চার.
পরিকল্পিত এ দাঙ্গার তাৎপর্য বিশ্লেষণে একাধিক দাঙ্গার তুলনা টানা এবং গণতন্ত্রের বিপন্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বিবিসির বিশ্লেষণে তুলনা টাকা হয়েছে ভয়াবহ গুজরাট দাঙ্গার (২০০২) সঙ্গে যখন নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী রাজনীতিকরাও ‘দিল্লি দাঙ্গায় গুজরাট দাঙ্গার মডেল’ দেখতে পাচ্ছেন। দ্বিতীয় তুলনীয়টি অনুরূপ ভয়াবহ। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর দিল্লিতে পরিকল্পিত শিখ নিধন যজ্ঞ। উভয় ক্ষেত্রে পুলিশ নীরব দর্শক। শেষোক্ত বিষয়টিতে সংগত কারণে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে একাধিক সংবাদ সংস্থা ও গবেষক মহলে।
তৃতীয় যে তুলনাটি টানা হয়নি তা হলো ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা (প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস উপলক্ষে)। সেখানে অবশ্য উভয়পক্ষে পূর্ব-প্রস্তুতি। কিন্তু সেখানেও পুলিশের ছিল একই ভূমিকা—এমনকি আধা শ্বেতাঙ্গ ‘ক্যালকাটা পুলিশের’ও। শাসক শ্রেণি নাকি মুচকি হেসে দুই দেশি পক্ষের হত্যা-উন্মাদনা দেখেছে। পরিণামে দেশ ভাগ। কথা হলো, এর পরও ভারত ও পাকিস্তানে যত গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, আমরা দেখেছি, প্রতিটিতে থেকেছে শাসকদের মদদ, উপলক্ষ যা-ই হোক। তুলনীয় ১৯৫০ সালের দাঙ্গা পূর্ববঙ্গে। পুলিশ যথারীতি নীরব দর্শক।
স্বভাবতই আজকের দিল্লি দাঙ্গার চরিত্র ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। এবারের উপলক্ষটিও সম্প্রদায়গত। কংগ্রেসি অপশাসনের পরিণামে এ সময়টির জন্য অপেক্ষা করছিল বিজেপি। তাই আসামসহ সারা ভারতে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে যতটা পারা যায় মুসলমানমুক্ত হিন্দু ভারত গড়া, যা তাদের রাজনৈতিক ‘স্বপ্ন’। যে ভুল, বুঝেশুনে জিন্নাহ করেছিলেন, (জানতেন মুসলিম পাকিস্তানে সব ভারতীয় মুসলমানের আবাস সংকুলান হবে না, তবু ভারত বিভাগ, স্বতন্ত্র পাকিস্তান), সেই একই ধারার ভুল পথে হাঁটছে বিজেপি। কয়েক কোটি ভারতীয় মুসলমানকে কোথায় তাড়িয়ে ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র গড়বে তারা। তবে হ্যাঁ, ভারতে মুসলিম শক্তিকে দুর্বল করে নির্যাতন করতে পারবে। তা কি নির্বিবাদ হবে? কয়েক কোটি মানুষ যদি কোনো দিন একজন বিচক্ষণ নেতার নেতৃত্বে একাট্টা হয়, তাহলে? বিশ্বজনমত ও নেতৃত্ব কি কয়েক কোটি মানুষ কাটা নীরবে দেখবে, বিশেষ করে চীন? শেষ প্রশ্ন : এ দাঙ্গায় কি করছেন কেজরিওয়াল ও তাঁর পার্টি? তিনিও তো এ দাঙ্গার নেপথ্য টার্গেট। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশে সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি যেন অটুট থাকে। এ দায় আমাদের সবার।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী