রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৬ পূর্বাহ্ন

আল্লাহর পথে ব্যয়

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩
  • ৮১ বার
প্রতিক ছবি

কুরআন মজিদ খুললেই সুরা ফাতিহা, যেটা ছাড়া নামাজ হয় না। সেখানে আমরা আল্লাহর কাছে হেদায়াত চাই। পাতা উল্টালেই আমরা পাই, এটা সেই কিতাব যার মধ্যে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই, নির্ভুল জীবন যাপনের বিধান। যদিও সমগ্র মানবজাতির জন্য কুরআন হেদায়াত কিন্তু হেদায়াত লাভ করতে সক্ষম হবে কেবল মুত্তাকিরা। মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে আল্লাহপাক ঈমান আনয়নের সাথে আরো দুটি গুণের উল্লেখ করেছেন, যারা নামাজ কায়েম করে এবং আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে ব্যয় করে (সূরা বাকারা)।

আল্লাহপাক উল্লেখ করেছেন, হেদায়াত তারাই পাবে যারা আল্লাহর পথে খরচ করে। অর্থাৎ কোনো কৃপণ, অর্থলোলুপ, স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণমনা লোক হেদায়াত লাভে সক্ষম নয়। আল্লাহর পথে ব্যয় অত্যন্ত ব্যাপক। নিজের পরিবারের জন্য, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য, ইয়াতিম-মিসকিন ও সাহায্যপ্রার্থীর জন্য, মসজিদ-মাদরাসাসহ সব নেক কাজে ব্যয় এবং সর্বোপরি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জন্য ব্যয়। সময় ও প্রয়োজন বিবেচনা করে এক একটি ব্যয় অগ্রাধিকার পায়। আমাদের ব্যয় করতে হবে অবশ্যই মৃত্যুর আগে, কারণ মৃত্যুর পর সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যায়। আল্লাহর বাণী, আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই তা থেকে খরচ করো। মৃত্যুর সময় সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে আর একটু সময় দিলে আমি দান করতাম ও নেক লোকদের মধ্যে শামিল হতাম’ (সূরা মুনাফিকুন ১০)। এখানে নেককার লোকদের অন্যতম গুণ হলো আল্লাহর পথে ব্যয় করা।

মানুষ ধন-সম্পদের মায়ায় বড় কাতর। যার যত বেশি আছে সে তত চায়। এমনকি কবরে পৌঁছার আগ পর্যন্ত (সূরা তাকাসুর) সে চায়। রাসূলুল্লাহ সা: কত সুন্দরভাবেই না বলেছেন। মানব সন্তানকে এক উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ দিলে সে আর একটি চায়। মাটি ছাড়া কোনো কিছু তাকে তৃপ্ত করতে পারে না। লিও টলস্টয়ের একটি গল্প পড়েছিলাম- একজন মানুষের কতটুকু জমির প্রয়োজন? লোকটিকে বলা হয়েছিল, সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতটুকু আয়ত্ত করতে পারবে ততটুকু তাকে দেয়া হবে। যত সামনে এগোয় ততই তার আকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। সূর্য গড়িয়ে পড়লে সে সম্বিত ফিরে পায় এবং ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসে প্রাণ হারায়। তাকে তখন সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে দাফন করা হয়। এই সাড়ে তিন হাত জমিই তার প্রয়োজন এবং এটিই গল্পের সার কথা।

জান্নাতের মালিকানা লাভের জন্য আল্লাহপাক তাঁর মুত্তাকি বান্দাদের প্রতিযোগিতা করার কথা বলেছেন। সেই মুত্তাকি বান্দাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে অন্যান্য গুণের সাথে সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় ব্যয়ের কথা বলেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা পাওয়ার কাজে প্রতিযোগিতা করো, আর সেই জান্নাতের জন্যও (প্রতিযোগিতা করো), যার প্রশস্ততা আকাশসমূহ ও পৃথিবী সমান, এটি মুত্তাকিদের জন্যই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে, (মুত্তাকি তারা) যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় (আল্লাহর পথে) ধন-সম্পদ ব্যয় করে, নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে দেয়; আল্লাহপাক উত্তম মানুষদের ভালোবাসেন’- সূরা আলে ইমরান ১৩৩-১৩৪। আজকের দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা হয় নাম-যশ-খ্যাতি ও সম্পদ বৃদ্ধির। অথচ দুনিয়াটা খুবই ক্ষণস্থায়ী।

আল্লাহর পথে ব্যয় জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আগুন থেকে বাঁচো একটি খেজুরের আঁটির খোসা দিয়ে হলেও’- বুখারি। সেই জাহান্নামের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে বাঁচাও যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’ জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য আমাদের প্রিয়তম নবী সা: তাঁর অনুসারীদের দান করার কথা বলেছেন। সেই দান কত ক্ষুদ্র সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা উভয় অবস্থাতেই দান করতে হবে।

আল্লাহর পথে ব্যয় সর্বাবস্থায়- গোপনে ও প্রকাশ্যে। আল্লাহর বাণী, ‘আমার ঈমানদার বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন নামাজ কায়েম করে এবং আমি যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে, গোপনে অথবা প্রকাশ্যে; সে দিন আসার আগেই যে দিন কোনো কেনা-বেচার সুযোগ থাকবে না, যে দিন কোনো বন্ধুত্ব কাজে আসবে না’- সূরা ইব্রাহিম ৩১।

ইসলামের মৌলিক ইবাদত নামাজ এবং নামাজের সাথে সাথে তাঁর পথে খরচের জোর তাগিদ রয়েছে। সব নেক কাজে ব্যয়ই আল্লাহর পথে, বিশেষ করে তাঁর বান্দাদের প্রয়োজনে। দান-সাদকায় আল্লাহর ক্রোধ দূর হয় ও রুজির প্রশস্ততা ঘটে।

অবস্থা ও পরিবেশ বিবেচনায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা বাকারা মদিনায় অবতীর্ণ। কুরআন মজিদের সর্ববৃহৎ সূরা। নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সে সময়ে যুদ্ধের ঘনঘটা। হিজরত করে এসে মদিনায় মুসলমানরা একটি রাষ্ট্র গঠন করেছে, সেই রাষ্ট্রে যদিও মক্কার মতো নিপীড়ন-নির্যাতন ছিল না কিন্তু সমগ্র আরব ও সব কুফরি শক্তি নবগঠিত রাষ্ট্রকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। তার বিপরীতে যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছিল এবং যে উদ্দেশ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে সে উদ্দেশ্যকে বাস্তব রূপদান অর্থাৎ নবগঠিত রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক ত্যাগ স্বীকার জরুরি হয়ে পড়েছিল।

যারা সোনা-রুপা জমা করে রাখে অর্থাৎ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। অবৈধ উপায়ে উপার্জন সবই হারাম তা যত সামান্যই হোক। বৈধ উপায়েও ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা ইসলামে পছন্দনীয় নয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এই সম্পদের মালিকের যেমন হক রয়েছে, তেমনি তাতে আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদেরও হক রয়েছে। কারণ সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। ইসলাম সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ পছন্দ করে না, ইসলাম চায় সম্পদ আবর্তিত হোক যাতে তার দ্বারা সমাজে সবাই উপকৃত হতে পারে। দান-খয়রাতের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে- ‘লোকেরা জিজ্ঞেস করে কী খরচ করবো? বলে দাও যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ইসলাম অপচয় ও কার্পণ্য দুটোই ঘৃণা করে। ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই’, আবার হাদিসে বলা হয়েছে- ‘কৃপণ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। ইসলাম চায় মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করতে। তাই আমাদের উচিত সম্পদের পেছনে না ছুটে, আল্লাহর সন্তুষ্টির পেছনে চলা।

মানুষের নিজের প্রয়োজন খুবই সামান্য। সাধারণত স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য হারাম-হালালের বাছবিচার না করে মানুষ সম্পদের পেছনে ছুটে। অথচ মৃত্যুর সাথে সাথে এই সম্পদ আর তার থাকে না। যাদের পেছনে সম্পদ ব্যয় করছে তারা কেউ তার কোনো কল্যাণে আসবে না। তাই আল্লাহপাক সতর্ক করে দিয়েছেন, কারো প্রেমে পড়ে যেন নিজের পরকাল নষ্ট না করে। হ্যাঁ, ব্যয়ের একটা বড় অংশ অবশ্যই নিজের পরিবার-পরিজনের উদ্দেশ্যে ব্যয় হবে এবং হাদিসের ভাষায় এই ব্যয় হবে সর্বোত্তম ব্যয়। এই ব্যয়টা হবে কর্তব্য পালন হিসেবে এবং তার পাশাপাশি কর্তব্য পালন হিসেবে আত্মীয়-স্বজন ও অন্যদের হক রয়েছে। কর্তব্য পালন হিসেবে যে ব্যয় সেটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়। ব্যয় অবশ্যই অবস্থার দাবি অনুসারে হতে হবে। যেমন, সামনে নির্বাচন। ইসলামপন্থী দল বা ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তাদের জন্য ব্যয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ হিসেবে সর্বোত্তম ব্যয় হবে।

মদিনায় হিজরত করার পর যুদ্ধকে সামনে রেখে যেসব সূরা অবতীর্ণ হয়েছে সেসব সূরায় জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে (জিহাদ) সর্বাধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে এবং এটিই স্বাভাবিক। ‘আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না’- সূরা বাকারা ১৯৫। সে দিন সাহাবায়ে কেরাম তাদের সব শক্তি নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময়ে তারা যদি কার্পণ্য করতেন এবং মুহাম্মদ সা: পরাজিত হতেন তাহলে দীনের বিস্তৃতি এত দূর ঘটতো না এবং মুসলিম পরিচয় দানও আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। ইসলামের দুশমনরা যদি বিজয়ী হয় তাহলে আবারও ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীর জীবনে ঘন অন্ধকার নেমে আসবে। এটা কোনো রাজনীতির কথা নয়। বরং এটিই দীনের মৌলিক দাবি এবং নবী প্রেরণের উদ্দেশ্যই হলো দীন কায়েম করা।

রাসূল সা:-এর জীবনে দীন প্রতিষ্ঠার কাজ কখনো মসৃণ ছিল না। এ কাজে বাধা-বিপত্তি, জুলুম-নির্যাতন মাড়িয়ে একপর্যায়ে মদিনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করলে সেখানে দীন বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমে তিনি সেখানে হিজরত করার পর নবগঠিত রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর হাতে আসে। বদর, ওহুদ, খন্দকসহ কয়েকটি যুদ্ধের পর অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র আরবের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের তিনি অধিকারী হয়ে পড়েন। মসজিদে নামাজের ইমাম হওয়ার সাথে সাথে বিচার-ফায়সালা, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় সব কর্ম নবী হিসেবেই তিনি সম্পন্ন করেছেন এবং ঈমানদার সবার জন্য জীবনের সব ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ বাধ্যতামূলক। একই জনপদ শুধু নেতৃত্ব আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের অনুসারীদের হাত থেকে নবী মুহাম্মদ সা: ও তাঁর সাথীদের হাতে আসায় বিশ^বাসী জুলুম ও নিপীড়নমূলক সমাজ থেকে এক শান্তি ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ লাভ করে।
সমাজে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারের মূলে রয়েছে অসৎ নেতৃত্ব। দীন প্রতিষ্ঠার অর্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব অসৎ ও খোদাবিমুখ লোকদের হাত থেকে সৎ ও মুত্তাকি লোকদের কাছে অর্পণ করা। সব যুগে নবী-রাসূলদের সাথে সমসাময়িককালের স্বৈরশাসকদের প্রচণ্ড বিরোধিতার কারণ নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ে।

তারা মনে করতো সমাজ ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্ব চলবে তাদের; আর নবীদের দাওয়াত ছিল তাগুতকে অস্বীকার করে জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য মেনে চলার দিকে। আল্লাহর আনুগত্য অর্থ নবী-রাসূলদের আনুগত্য। তাই স্বৈরশাসকরা সবসময় নবী-রাসূলদের নিজেদের প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করে সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের দাওয়াত প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। দেশে দেশে সৎ মানুষের অভাব নেই। সমস্যা হচ্ছে তারা সংগঠিত নয় এবং তারা রাজনীতি নিরপেক্ষ ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মের এই ভুল ব্যাখ্যা থেকে মানুষ ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসছে। ফলে ইসলামপন্থী দল ও জনগোষ্ঠী দীন বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে। আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল সা: ও আখিরাতে বিশ্বাসী সব জনগোষ্ঠীর সুযোগ এসেছে দীন তথা সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় শরিক হওয়ার।

লেখক:

  • প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com