আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী দেশে প্রথমবারের মতো প্রকৃত রিজার্ভ কত আছে সেটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সে হিসেবে দেশে এ মুহূর্তে রিজার্ভ আছে ২৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার।
এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক দুই পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করেছে। একটি হচ্ছে – আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের শর্ত মেনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি, আরেকটি হচ্ছে – বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব পদ্ধতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ আছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রকৃত রিজার্ভ সাড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও নেট রিজার্ভ অর্থাৎ এখনই ব্যবহার করা যাবে এমন রিজার্ভ হবে আরো তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার কম।
তারা বলছেন, রিজার্ভ ধরে রাখতে যেসব সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোকে কার্যকর রেখেই রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রবণতা তৈরি করতে হবে। অন্যথায় রিজার্ভ হতে পারে খুব শিগগিরই গভীর দুশ্চিন্তার কারণ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত আছে এনিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার ও নিরপেক্ষ গবেষণা সংস্থাগুলোর মধ্যে বিতর্ক চলছিল অনেক দিন ধরেই। স্বাধীন গবেষকরা আগে থেকেই বলে আসছিলেন যে রিজার্ভ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে না।
সম্প্রতি আর্থিক সহায়তার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে যে আলোচনা করেছে তাতে সংস্থাটি চলতি বছর জুন মাসের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ হিসাব করার শর্ত দিয়েছিল। এমন বিভিন্ন শর্তেই সংস্থাটি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে বাংলাদেশের জন্য।
ফলে রিজার্ভের অর্থে যেসব তহবিল গঠিত হয়েছে বা রিজার্ভ থেকে অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্পে সহায়তা করা হয়েছে সেসব অর্থের হিসেব বাদ দিয়ে এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রিজার্ভ সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে হয়েছে।
সরকার বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে ও পায়রা বন্দর সম্পর্কিত প্রকল্প ছাড়াও রিজার্ভের অর্থে রফতানি উন্নয়ন তহবিল করেছিল। রিজার্ভের অর্থ ‘অলস’ পড়ে আছে- এমন যুক্তি দেখিয়ে সেগুলোকে কাজে লাগানোর কথা বলে সরকার বিভিন্ন কাজে রিজার্ভের অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, সর্বমোট রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলার দেখানো হলেও নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৯/২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না, যা দিয়ে হয়তো সংকটে পড়লে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হতে পারে।
‘কিন্তু উদ্বেগের জায়গা হলো এটা ধারাবাহিকভাবে কমছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের অনেক পদক্ষেপ নেয়া হলো এবং আমদানি কমলো। আবার রফতানি আশা অনুযায়ী না হলেও খারাপ হয়নি। তারপরেও রিজার্ভ ঘাটতি কমছে না। বরং রিজার্ভের ক্ষয় চলছে। এটিই চিন্তার বিষয়,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ।
গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এখন একটি ‘রেড জোনে’ আছে রিজার্ভ পরিস্থিতি।
‘মাত্র দু বছর আগের ৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ অর্ধেকে নেমে আসা উদ্বেগের। এটি আরো কমবে কি-না অথবা এটি থেকে ক্রমাগত বাড়ে কি-না সেটিই হবে সবার জন্য দেখার বিষয়। যদি সরকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধির প্রবণতা তৈরি করতে পারে তাহলে মানুষ আশার আলো পাবে। কিন্তু নেতিবাচক হলে সেটা হবে গভীরতর দুশ্চিন্তার কারণ,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ মে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ তিনি দেখছেন না।
রেকর্ড থেকে সংকট
করোনা মহামারীর মধ্যেই ২০২১ সালের অগাস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলারে।
সে বছর ২৯ জুলাই সেই অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সেই অর্থবছরেই ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার আশা প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু পরের বছর জুলাইয়ে এটি কমে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। আর চলতি ২০২৩ সালের মে মাসে রিজার্ভ নেমে আসে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
মূলত করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় ব্যাপক বেড়ে যাওয়া আর বৈশ্বিক পরিস্থিতিকেই রিজার্ভ কমার কারণ হিসেবে বলেছিল সরকার।
এর মধ্যে দেশে তীব্র ডলার সংকট তৈরি হলে সহায়তার জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয় সরকার। সংস্থাটির ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে নেয়া হয় নানা সংকোচনমূলক পদক্ষেপ।
এর মধ্যেই বড় আলোচনার বিষয় ছিল রিজার্ভের হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে হিসাব করছিল সেটিকে গ্রহণ না করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ হিসেবায়নের শর্ত দেয় আইএমএফ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এতদিন সরকার, জনগণ, বিনিয়োগকারী, দাতা সংস্থাসহ সবার মধ্যেই যে বিভ্রান্তি ছিল এখন তা নিরসন হবে এবং এর ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে।
অনেক পদক্ষেপ, তবুও কমছে রিজার্ভ
ব্যাপক ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যয় সংকোচনের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার।
এমনকি এর অংশ হিসেবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে যে মুনাফা করেছে সেটিও এখনই দেয়া হচ্ছে না আবার রয়্যালটির ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় ডলারের বদলে টাকা অফার করা হয়েছে।
পাশাপাশি বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা এদেশে ব্যবসা করছে তাদের ক্ষেত্রে ডলারে পেমেন্ট এড়ানোর জন্য সেসব ব্যাংককে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
আবার বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগকারীদের পেমেন্ট বাকি রাখা ছাড়াও বিদেশ থেকে বাকিতে জ্বালানি কিনছে সরকার। গাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করা হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও সরকারের অনেক পদক্ষেপ বা সংকোচন নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি বলেই মনে করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এখন সরকার আরো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে আশা করছেন তিনি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে অবস্থায় আছে সেখান থেকে বৃদ্ধি করার ধারায় আনতে না পারলে দুশ্চিন্তার কারণ আছে বলে মনে করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এখন মোট রিজার্ভ যা আছে মুদ্রানীতির ব্যবস্থাপনা আর ঝুঁকি মোকাবেলায় সেটি পর্যাপ্ত কি-না – সেটাও চিন্তার বিষয়।
‘ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ যে ৩০ বিলিয়ন ডলারের অনেক কম ছিল সেটি এতদিন স্বীকার না করলেও সবার জানা ছিল। এখনো দেখতে হবে যে প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারের মতো রিজার্ভ কতটা আছে। আরো উদ্বেগের জায়গা হলো, এটা ধারাবাহিকভাবে কমছে,’ বলেন তিনি।
রিজার্ভের ভুল চিত্রায়ন
অর্থনীতিবিদরা অনেকে মনে করেন, রিজার্ভ সম্পর্কে আগে থেকেই অনেক ভুল ধারণা দেয়া হয়েছে জনমনে এবং এর ফলে রিজার্ভ অলস পড়ে আছে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল অনেকের মধ্যে।
আর এসব প্রচারণাকে ব্যবহার করেই অবকাঠামোর জন্য তহবিল করা হয়েছিল রিজার্ভ থেকে।
জাহিদ হোসেন বলেন, এখানে রফতানিকারকরা রিজার্ভ থেকে সস্তায় ঋণ চেয়েছেন, রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বাড়ানো হয়েছে। এমনকি ব্যবসায়ীরা অনেকে রিজার্ভ থেকে ঋণ চেয়েছেন।
‘এসব চাপ তৈরি হয়েছিল রিজার্ভকে অলস টাকা হিসেবে প্রচার করায়। তখন ধারণা দেয়া হয়েছিলো যে বাংলাদেশের হাতে অতিরিক্ত রিজার্ভ আছে,’ বলেন তিনি।
আবার রিজার্ভের টাকা ব্যবহার করে সরকার আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক ইমেজ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে এমন অভিযোগও আছে।
শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে তা এখনো ফেরত পায়নি বাংলাদেশ। আরো একটি দেশ একই কায়দায় ঋণ চেয়েছিল এবং তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল সরকার পর্যায়ে।
‘এগুলো ছিল পলিটিক্যাল ইমেজ বিল্ডিং টাইপ—অন্য দেশকে ঋণ দেয়া। ফলস সেন্স অব প্রাইড তৈরি করা হয়েছিল রিজার্ভ নিয়ে। ফলে অনেক সিদ্ধান্ত ছিল ভুল,’ বলেন জাহিদ হোসেন।
তার মতে, এখন রিজার্ভের প্রকৃত তথ্য আসায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
সূত্র : বিবিসি