নবী করিম সা: বলেছেন, যে কাজ আল্লাহর নামে আরম্ভ করা না হয়, উহা লেজকাটা, উহার পরিণাম শুভ ও কল্যাণময় হয় না। আমরা যেকোনো ভালো কাজ শুরু করব আল্লাহর নামে, অর্থাৎ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করব। বিসমিল্লাহ শরিফের বরকত অনেক বেশি, এতে রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য। হজরত নূহ আ:-এর জামানায় তাঁর জাতির ওপর গজব এসেছিল। আকাশ থেকে অনবরত ভারী বৃষ্টি শুরু হলো এবং জমিন ডুবে গেল। সেই বিপদের সময় হজরত নূহ আ: তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আল্লাহর নামে নৌকায় আরোহণ করলেন। আল্লাহ বলেন, যখন তুমি ও তোমার সঙ্গীরা নৌযানে আরোহণ করবে তখন বলো, সমস্ত প্রশংসা ওই আল্লাহরই যিনি আমাদের উদ্ধার করেছেন জালিম সম্প্রদায়ের হাত থেকে। আর বলো, হে আমার রব! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করিয়ে নিন যা হবে কল্যাণকর, আর আপনি শ্রেষ্ঠ অবতরণকারী (সূরা আল মুমিনূন, ২৮-২৯)। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, আর সে বলল : তোমরা এতে আরোহণ করো, এর গতি ও এর স্থিতি আল্লাহরই নামে, নিশ্চয়ই আমার রব ক্ষমাশীল, দয়াবান (সূরা হুদ, আয়াত-৪১)। আমরা যদি যেকোনো ভালো কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ শরিফ পড়ি, তাহলে সেই কাজের অনেক সফলতা আসবে এবং বিপদ আপদ থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবে। প্রিয় পাঠক, আমরা বিসমিল্লাহ শরিফের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানব, ইনশাআল্লাহ।
বিসমিল্লাহ শরিফের ফজিলত ও বিস্ময়কর প্রভাব : হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, প্রত্যেক এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া হয়নি তা অসম্পূর্ণ থেকে যায় (মুসনাদে আহমাদ, ১৪/৩২৯)। বিসমিল্লাহ একটি শক্তিশালী আমল। এর মাধ্যমে শয়তানের কার্যক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। অকল্যাণ ও অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আবু মুলাইহ থেকে বর্ণিত, তিনি একজন সাহাবি থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি একবার নবী সা:-এর সঙ্গে তাঁর আরোহীর পেছনে বসা ছিলাম। এমন সময় আরোহী পা ফসকে পড়ে গেল। তখন আমি বললাম, শয়তান ধ্বংস হোক। নবী সা: বলেন, ‘শয়তান ধ্বংস হোক এরূপ বলো না, কেননা এতে সে নিজেকে খুব বড় মনে করে এবং বলে আমার নিজ শক্তি দ্বারা এ কাজ করেছি; বরং এরূপ মুহূর্তে বলবে ‘বিসমিল্লাহ’। এতে সে অতি ক্ষুদ্র হয়ে যায়, এমনকি মাছিসদৃশ হয়ে যায় (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-১৯৭৮২)। খাওয়া দাওয়াসহ যেকোনো কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া হলে সেই কাজে শয়তানের অংশীদারি থাকে না। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে খাবারে বিসমিল্লাহ পড়া হয় না, সে খাবারে শয়তানের অংশ থাকে। সেই খাবার মানুষের সঙ্গে শয়তানও ভক্ষণ করে (মুসলিম, হাদিস-৫৩৭৬)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে ‘শয়তান সেই খাদ্যকে নিজের জন্য হালাল করে নেয়, যে খাদ্যের ওপর বিসমিল্লাহ বলা হয় না’ (মুসলিম, হাদিস-২০১৭)। প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা:-এর কাছে প্রথম ওহি নাজিলের সময়ও এ উত্তম বাক্য পড়ানো হয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘জিবরাঈল আ: সর্বপ্রথম মুহাম্মদ সা:-এর প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তা হচ্ছে জিবরাইল আ: বলেন, হে মুহাম্মদ! আপনি আশ্রয় চান। মুহাম্মদ সা: বলেন, আমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় চাই। অতঃপর জিবরাইল আ: বলেন, হে নবী! আপনি বলুন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’ (তাফসির ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা- ২৬৩)
বিসমিল্লাহর মর্যাদা রক্ষা : দাওয়াতনামা, পোস্টার ও ব্যানার, যা নির্ধারিত সময়ের পর কোনো প্রয়োজন হয় না, আবার প্রয়োজন শেষে পথে-ঘাটে ও নর্দমায় পড়ে থাকে, কিন্তু বর্তমানে বরকত লাভের আশায় সেগুলোতেই আমরা বিসমিল্লাহ লিখে এর অমর্যাদা করছি। মনে রাখতে হবে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম কুরআনের একটি মর্যাদাপূর্ণ আয়াত। কুরআনের অন্য আয়াতের মতো এর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা অপরিহার্য। তাই এসব ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আরবি বাংলা কোনোভাবে লেখা উচিত নয় (ফাতাওয়া হিন্দিয়া-৫/৩২৩)। চিঠিপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লেখা সুন্নাত। কিন্তু অনেকেই বিসমিল্লাহর পরিবর্তে ৭৮৬ লেখা থাকে। এটা জায়েজ নয়। এতে বিসমিল্লাহর বরকত ও ফজিলত কিছুই পাওয়া যাবে না। এ রীতি পরিহার করা উচিত। কারো কারো ‘বিসমিহি তায়ালা’ লেখার অভ্যাস আছে। এতে আল্লাহর নাম স্মরণ করার সওয়াব পাওয়া যাবে, তবে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখার স্বতন্ত্র সুন্নাত আদায় হবে না (আহসানুল ফাতাওয়া-৮/২৪)। ফাতাওয়া উছমানি ১/১৬৩) মোটকথা লিফলেট, পোস্টার বা কোনো ধরনের কাগজের টুকরো, যেগুলো সাধারণত সংরক্ষণ করা হয় না সেসব কাগজে ‘বিসমিল্লাহ’ না লিখে বরং তা আরম্ভ করার সময় শুধু মুখে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করে নিলে এর ফজিলত ও বরকত পাওয়া যাবে (শারহু মুসলিম নববী-২/৯৮)।
রোম সম্রাটের কাহিনী : ছওলতে ফারুকী নামক কিতাবে আছে, রোম সম্রাট কায়সার ইসলাম গ্রহণের পর একদা আমিরুল মোমেনিন হজরত ওমর ফারুক রা:-এর সমীপে এই আর্জি পেশ করিলেন, হুজুর! সব সময় আমার ভীষণ মাথাব্যথা থাকে, চিকিৎসার অনেক চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু কোনোই ফল হয় নাই।
সম্রাটের এই আরজনামা পাইয়া হজরত ওমর রা: একটি কালো টুপি সেলাই করাইয়া দিলেন। আমিরুল মোমেনিনের তরফ হইতে একটি টুপি আসিতেছে এই সংবাদ পাইয়া সম্রাট খাছ নিয়তে ভক্তিভরে কিছু পথ আগাইয়া গেলেন এবং পরম শ্রদ্ধার সহিত টুপিটি গ্রহণ করিয়া মুকুটের মতো স্বীয় মস্তকে পরিধান করিলেন আর অমনি তাঁহার দীর্ঘদিনের মাথাব্যথা দূর হইয়া গেল। যতক্ষণ টুপিটি তাহার মস্তকে শোভা পাইত, ততক্ষণ তিনি আরামে থাকিতেন। আর যখনই উহা মাথা হইতে খুলিয়া রাখিতেন, তখন আবার মাথাব্যথা আরম্ভ হইত। এই অবস্থা দেখিয়া সম্রাট বিস্মিত হইলেন এবং খুঁজিতে লাগিলেন-টুপির এই মাহাত্ম্যের আসল রহস্য কোথায়! খুঁজিতে খুঁজিতে তিনি দেখিলেন, টুপির সঙ্গে এক টুকরা কাগজ জড়ানো এবং উহাতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম কথাটি লিখিত রহিয়াছে।
বোঝা গেল, বিসমিল্লাহ শরিফের বরকতে ব্যথা-যন্ত্রণা এবং সব রোগও নিরাময় হইয়া থাকে। হজরত মাওলানা রুমি মসনভীতে বলেন : তাসমিয়া আমদ এলাজে হার মারাজ, গুদরাওয়া হারকাস কে খানাদ হার গারাজ। অর্থাৎ, বিসমিল্লাহ শরিফ হইল যাবতীয় রোগের মহৌষধ, যেই ব্যক্তি ইহা পাঠ করিবে, তাহার সকল মকছুদ পূর্ণ হইবে। আসুন আমরা যেকোনো ভালো কাজের শুরুতে বেশি বেশি বিসমিল্লাহ শরিফ পড়ব এবং বরকত লাভ করব।
লেখক :
আলেম, প্রাবন্ধিক