‘গত কয়েকদিন ধরে ডিমের দাম শুনে অনেক কাস্টমার গালাগাল দিচ্ছে। অনেকে বুঝলেও কেউ কেউ মনে করে দোকানদাররা ইচ্ছা করে দাম বেশি চাইছে। তাদেরকে কিভাবে বোঝাবো যে এখানে আমাদের কিছু করার নেই’, আক্ষেপ করছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের মুদি দোকানদার লতিফ হোসেন।
ডিমের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে হঠাৎই অনেকটা বেড়ে যাওয়ার ফলে কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, তারই বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম প্রতি ডজনে ২০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সাত থেকে ১০দিন আগেও খুচরা বাজারগুলোতে যেখানে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা, শুক্রবার সেসব বাজারে এক ডজন ডিমের সর্বনিম্ন মূল্য ছিল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। পাড়া বা মহল্লার ভেতরের দোকানগুলোতে কোথাও কোথাও ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা ডজন পর্যন্ত ডিম বিক্রি হচ্ছে।
অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিমের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। এ বছরের শুরুতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজন প্রতি প্রায় ৩০ টাকা বেড়েছিল। এর আগে গত আগস্টেও ডিমের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। পরে বর্ষা শেষে দাম কমে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা হয়।
তবে এবারে এক ডজন ডিমের দাম ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা হওয়ার ঘটনাকে বলা হচ্ছে- বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিমের সর্বোচ্চ দাম। আর এই দাম বৃদ্ধির পেছনে একাধিক বিষয় কাজ করছে বলে দাবি করছেন ডিম ব্যবসার সাথে জড়িতরা।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বা টিসিবি’র হিসেব অনুযায়ী দুই দিনের ব্যবধানে প্রতি হালি ডিমের দাম ৭ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী, গত বছর এই সময় ডিমের দাম ছিল ডজন প্রতি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ডিমের দাম প্রতি ডজনে বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, বা প্রায় ২৫ শতাংশ।
ব্যবসায়ীদের যুক্তি
অধিকাংশ কৃষি পণ্যের মতোই ডিম খামারির কাছ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে আড়তদার, পাইকার, সরবরাহকারী, খুচরা ব্যবসায়ীসহ একাধিক হাত ঘুরে পৌঁছায়।
ডিমের খামারিদের কাছ থেকে আড়তদাররা ডিম সংগ্রহ করেন। স্থানীয় আড়ত থেকে আশেপাশের এলাকার পাইকারি ডিম ব্যবসায়ীরা ডিম কিনে নেন। এরপর তাদের কাছ থেকে সরবরাহকারীরা কিনে নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ডিম বিক্রি করেন। অনেক সময় খুচরা ব্যবসায়ীরা নিজেরাই পাইকারদের কাছ থেকে ডিম কেনেন।
স্বাভাবিকভাবেই, উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছানো পর্যন্ত যত বেশি মধ্যস্বত্ত্বভোগী থাকে, পণ্যের খুচরা মূল্য ততই বাড়তে থাকে।
তবে ডিম ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ডিমের দাম ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বাড়ার পেছনে অন্যান্য কারণও রয়েছে।
যেমন খুলনার ডিমের খামারি মাসুদ হোসেনের দাবি, এ বছর অতিরিক্ত গরম আর অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ডিমের চাহিদা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
“কয়েকমাস আগে যখন টানা তাপপ্রবাহ চলেছে, তখন অধিকাংশ খামারেই মুরগি মারা গেছে। আমার খামারে অল্প কিছু মুরগি মারা গেছে। কিন্তু এমন অনেক খামার আছে যেগুলোতে কয়েকদিনের ব্যবধানে হাজার হাজার মুরগি মারা গেছে”, বলছিলেন হোসেন।
মাসুদ হোসেন বলছিলেন, গরমে মুরগি মারা যাওয়ার কারণে তার আশেপাশের এলাকার অনেক খামারিই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে ডিমের উৎপাদন অনেকটাই কমে গেছে বলে বলছিলেন তিনি।
এছাড়া গত কয়েকদিনে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ডিমের সরবরাহ ও সংগ্রহের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারণেও গত কিছুদিনে ডিমের দাম বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি তেলের দাম বাড়াও ডিমের দামে প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করেন হোসেন।
ডিমের উৎপাদন কমার বিষয়টি নিশ্চিত করেন গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা উপজেলার আড়তদার সাইফুল ইসলামও। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সিংহভাগ ডিম পাইকারদের কাছে সরবরাহ করা হয়ে থাকে বামনডাঙ্গার আড়ত থেকে।
সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, “কয়েকমাস আগেও দৈনিক এই আড়ত থেকে অন্তত সাড়ে তিন লাখ ডিম বিক্রি করা হত। গত কয়েকদিন ধরে সেই সংখ্যা দৈনিক এক লক্ষে নেমেছে।”
সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, এক মাস আগেও খামারিদের কাছ থেকে একশো ডিম ৯৮০ থেকে এক হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। কিন্তু এখন প্রতি ১০০ ডিমের দাম ধরা হয়েছে ১১০০ টাকা।
ডিমের চাহিদা থাকলেও জোগান না থাকায় অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী প্রয়োজনের তুলনায় কম ডিম কিনছেন বলে জানান ইসলাম।
পাইকারি ব্যবসায়ীরাও বলছেন ডিমের চাহিদা থাকলেও যথেষ্ট পরিমাণ সরবরাহ নেই বলে আড়তদারদের পক্ষ থেকে তাদের বলা হচ্ছে। চট্টগ্রামের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী ইমাম হোসেন বলছিলেন যে আড়তদাররা কয়েকমাসের ব্যবধানে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি দামে ডিম বিক্রি করছেন তাদের কাছে।
“এক ট্রাক ডিমের দাম কিছুদিন আগেও ছিল ১২ লাখ টাকা (১ লক্ষ ৪৬ হাজার), সেখানে গত কয়কেদিনে ঐ একই পরিমাণ ডিমের দাম আড়তদাররা চাচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা”, বলছিলেন ইমাম হোসেন।
পাইকারি ব্যবসায়ী ইমাম হোসেনও বলছিলেন যে ডিমের দাম বাড়তে থাকায় অনেক ছোট খামারিই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।
যেভাবে ঠিক হয় ডিমের দাম
বাংলাদেশের একেক এলাকায় স্থানীয় ডিম ব্যবসায়ী সমিতি সাধারণত নির্ধারণ করে থাকে যে কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে ডিমের দাম কত হবে।
ঢাকা ও আশেপাশের এলাকাায় ‘তেজগাঁও ডিম সমিতি’ প্রতিদিন দুপুরের মধ্যে নির্ধারণ করে থাকে যে ওইদিন ডিমের দাম কত হবে। তারা আশেপাশের অন্যান্য আড়তদারদের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে বাজারের পরিস্থিতি যাচাই করে ডিমের দাম নির্ধারণ করে।
এরপর দুপুর ১২টার মধ্যে পরে আশেপাশের আড়তগুলোতে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয় সিদ্ধান্ত।
একইভাবে রাজশাহী ও কিশোরগঞ্জের ডিম ব্যবসায়ী সমিতি থেকেও সেসব এলাকা ও আশেপাশের এলাকার ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়।
দেশের সব এলাকায় আড়তদাররা ডিম সংগ্রহ করলেও এই তিন এলাকায় সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ করার কারণে এই তিন অঞ্চলের বাজার পর্যালোচনা করে ডিমের দাম ঠিক করা হয়।
সূত্র : বিবিসি