ডলার সঙ্কট ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের দিক থেকে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের বিনিময় হারের ঝুঁকি ৬৮ শতাংশ। এদের কারণে বাজারের ওপর ঝুঁকি রয়েছে ২০ শতাংশ। বাকি ৫১টি ব্যাংক শতভাগ ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের কারণে মার্কেট ঝুঁকি রয়েছে সাড়ে ২৯ শতাংশ। শুধু বিনিময় হারের কারণেই নয়, বিনিময় হারের চাপের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন চার্জ (ঝুঁকির বিপরীতে সংরক্ষিত মূলধনের পরিমাণ) বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে এ মূলধন চার্জ যেখানে ছিল এক হাজার ৬০ কোটি টাকা, ২০২২ সালে তা ৩০০ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বার্ষিক প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ২০২২ সালের ব্যাংক খাতের সামগ্রিক আর্থিক সূচকের ওপর ভিত্তি করে। গত রোববার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে বিনিময় হার নিয়ে এত ঝুঁকি ছিল না। কিন্তু বিদায়ী বছরের শুরু থেকেই ডলারের সঙ্কট শুরু হয়। আর এ সঙ্কট বছরের মাঝামাঝিতে তীব্র আকার ধারণ করে। একদিকে ডলারের জোগান বেড়ে যায়। সেই সাথে বেড়ে যায় ডলারের দাম। এর ফলে আমদানি ও বৈদেশিক ঋণের দায় পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যায়। পাশাপাশি বেড়ে যায় ব্যাংকের মূলধন ঝুঁকির মাত্রা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে গিয়ে বাজার থেকে বড় একটি অংশ নগদ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে চলে আসে। এতে টাকার সঙ্কট দেখা দেয়। এ সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উপকরণ যেমন রেপো, বিশেষ রেপো ও তারল্য সহায়তার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে আবার টাকা সরবরাহ করে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ বাজার ২০২২ সালে একটি মাঝারি মানের স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করেছে। যদিও বিনিময় হারের পরিমিত ওঠানামায় বাংলাদেশী টাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে একটি অবমূল্যায়িত হয়েছে বছরজুড়ে। এতে রফতানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়লেও আমদানি ব্যয়ে চাপ বেড়েছে। একই সাথে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে সম্পদ, দায় এবং আনুষঙ্গিক দায়, বৈদেশিক মুদ্রার খাতে আয় আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাবের রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এতে যে বৈশ্বিক মন্দা সৃষ্টি হয় তার ঢেউ বাংলাদেশেও ভালোভাবেই লেগেছে। এ কারণে ঋণের সুদহারও বাড়াতে হয়েছে। এর সামগ্রিক প্রভাব ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে মূলধন ঝুঁকির মাত্রা।
এ দিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার খেলাপি ঋণ বাড়লে খেলাপির ধারণ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে ব্যাংক ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। এ দিকে প্রভিশন ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলোর পুঁজি ও রিজার্ভ বা সংরক্ষিত তহবিলের একটি অংশ নন-পারফর্মিং সম্পদে (যে সম্পদ থেকে কোনো আয় আসে না) পরিণত হচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক স্থানীয় এবং আন্তঃদেশীয় দুই ক্ষেত্রেই সাইবার নিরাপত্তার হুমকি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এতে লেনদেনের মাত্রা এবং যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এক দিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, অপরদিকে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এতে সামগ্রিকভাবে রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। রিজার্ভ ক্রমান্বয়েই কমে যাচ্ছে। এখনো বৈদেশিক মুদ্রা আয় দিয়ে চলতি ব্যয়সহ আগে দায় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে চাপের প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে। ধীরে ধীরে তা আরো কমে যাবে। এদিকে ডলারের দাম ২০২১ সালের শেষ দিকে ৮৫ টাকা। ২০২২ সালের শেষ দিকে তা বেড়ে হয়েছে ১০৪ টাকা। এখন তা আরো বেড়ে ১০৯ টাকা।