অদৃশ্য বিশ্বাসের কথা শুনলে নাস্তিকরা সর্বদা ঠাট্টাবিদ্রুপ করে থাকে। আল্লাহ, ফেরেশতা, ওহি, নবী-রাসূল, আখিরাত, কিয়ামত, জান্নাত-জাহান্নাম, তাকদির ইত্যাদির কথা বলা হলে তারা কেবল ঠাট্টাবিদ্রুপ করে উড়িয়ে-ই দেয় না; বরং কু-মতলবে ঠাট্টাচ্ছলে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কিয়ামত দিবসটি কবে আসবে?’ উত্তরে আল্লাহ নিজেই বলে দেন- ‘যখন চোখ ঝলসে যাবে, চাঁদ আলোহীন হবে এবং চাঁদ-সূর্য মিলিয়ে একাকার করে দেয়া হবে; তখন মানুষ বলবে, কোথায় পালিয়ে যাবো? কখনোই নয়! সেখানে কোনো আশ্রয়স্থল হবে না। সে দিন মানুষকে তার আগের পরের সব কৃতকর্ম জানিয়ে দেয়া হবে; বরং মানুষ নিজেকে খুব ভালোভাবেই জানে, সে যতই অজুহাত পেশ করুক না কেন।’ (সূরা আল-কিয়ামাহ : ৭-১৫)
আস্তিকেরা বিশ্বাস করে নিখিল বিশ্বের একজন স্র্রষ্টা আছেন। তিনি সবকিছু পরিচালনা করছেন। তবে মানুষকে অর্থাৎ মানুষ নামের জীবকে আত্মপরিচালনার স্বাধীনতা ও দায়িত্ব দিয়েছেন। সে স্র্রষ্টার অনুগত হয়ে তাঁরই (আল্লাহর) ইচ্ছামতো নিজেকে পরিচালনা করলে পৃথিবীতে শান্তি পাবে এবং পরকালে পাবে সীমাহীন সুখ-শান্তি সমৃদ্ধ পুরস্কার। পক্ষান্তরে স্বেচ্ছাচারী মানুষ দুনিয়ায় অশান্তি এবং পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে। স্র্রষ্টা নিজ ইচ্ছায় একদিন মহাপ্রলয় ঘটিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেবেন এবং এরপর আবার মানুষকে কবরের বুক থেকে জীবিত করে তুলবেন। অতঃপর একটি মহাসমাবেশে সব মানুষকে একত্রিত করে প্রত্যেকের পার্থিব কাজের হিসাব নেয়া হবে। বিজ্ঞানীরা আজ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, আল্লাহর অস্তিত্ব, ওহির বাস্তবতা, কিয়ামত, হাশর ও পরকালের অবশ্যম্ভাবিতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুনিয়াভরা অবদান কোনো না কোনো ব্যক্তির হাতে তৈরি এবং যিনি যা তৈরি করেন তার পরিচালনাবিধি তিনিই রচনা করে দিতে পারেন নির্ভুলভাবে। বিবেকবান মানুষ মনে করে, একটি ছোট্ট কুটির কিংবা ছোট্ট মোটরগাড়ি যদি কোনো না কোনো মিস্ত্রি বা কারিগর ছাড়া তৈরি হতে না পারে, তবে ক্ষুদ্র পিপিলিকা বা মশা-মাছিই কিভাবে একজন স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে? যে আল্লাহ মানুষকে একবার সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি প্রয়োজনে আবার পুনরুত্থান করতে পারবেন না কেন? দুনিয়ার জীবনে যে অপরাধীর বিচার হলো না, তার উচিত বিচারের জন্য; কিংবা যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কেবল ভালো কাজই করে গেল কিন্তু তার ফল বা পুরস্কার এ জীবনে পেল না, তার যথাযথ পুরস্কার লাভের জন্য সবচেয়ে সুবিচারক মহান আল্লাহ, হাশরের দিনে বিচারের ব্যবস্থা করবেন না কেন?
জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে, সূর্য প্রতিনিয়ত কিছু তাপ হারাচ্ছে। একসময় তাপশূন্য হয়ে বর্তমান অস্তিত্ব বদলে যাবে। ফলে এর গ্রহ-উপগ্রহের প্রতি আকর্ষণ না থাকায় এরা চতুর্দিকে ছিটকে পড়বে, সৌরজগৎ বিপর্যস্ত হবে। এভাবে অন্যান্য নক্ষত্রেও একই অবস্থা ঘটলে যা হবে তাকেই কিয়ামতের সময় তারকারাজি ছিঁড়ে ছুটে পড়ে যাবে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এ কথা এভাবেই বলা হয়েছে, ‘যখন সূর্য গুটিয়ে নেয়া হবে। যখন নক্ষত্ররাজি চার দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। যখন পাহাড়গুলোকে চলমান করা হবে।’ (সূরা আত-তাকভির : ১-৩)
আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া এবং তাঁর পুরস্কার পাওয়ার জন্য তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টায় রত থাকতে হবে। তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় কারো নেই। তিনি বলেন- ‘তোমরা প্রতিযোগিতার সাথে কল্যাণের দিকে এগিয়ে যাও। তোমরা যেখানেই থাকবে, আল্লাহ তোমাদেরকে নিশ্চয় পাবেন। কোনো কিছুই তাঁর শক্তির বাইরে নয়।’ (সূরা আল-বাকারাহ-১৪৮)
তিনি সবকিছু জানেন ও দেখেন। তাঁর দৃষ্টির বাইরে গিয়ে পালিয়ে থেকে কেউ আত্মরক্ষা করতে পারবে না। তিনি বলেন- ‘তোমাদের কি বলিনি যে, আমি আকাশ ও জমিনের যাবতীয় সব নিগূঢ় তত্ত্ব জানি, যা তোমরা জানো না। আসলে তোমরা যা প্রকাশ করো তা, আর যা গোপন করো তা-ও আমার জানা আছে।’ (সূরা আল-বাকারাহ-৩৩)
‘তিনিই আল্লাহ, যিনি আকাশেও রয়েছেন এবং পৃথিবীতেও। তোমাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব অবস্থাই তিনি জানেন, আর ভালো ও মন্দ যা কিছু তোমরা উপার্জন করো, সে সম্পর্কেও তিনি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।’ (সূরা আনআম-৩)
‘সমস্ত গায়েবের চাবিকাঠি তাঁরই কাছে। তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। স্থল ও জলভাগে যা কিছু আছে, তিনি তার সবকিছু জানেন। বৃক্ষচ্যুত একটি পাতাও এমন নেই, যে সম্পর্কে আল্লাহ জানেন না।
জমির অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্দার অন্তরালে একটি দানাও এমন নেই, যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। ভেজা ও শুকনো জিনিস সবকিছু এক উন্মুক্ত কিতাবে লিখিত রয়েছে। তিনি রাতে তোমাদের রূহ কবজ করেন, আর দিনে তোমরা যা কিছু করো, তা-ও তিনি জানেন। আর দ্বিতীয় দিনে তিনি তোমাদেরকে সেই কর্মজগতে ফেরত পাঠান, যেন জীবনের নির্দিষ্ট আয়ু পূর্ণ করতে পারো। কেননা শেষ পর্যন্ত তাঁরই কাছেই ফিরে যেতে হবে। তখন তোমরা কী কাজ করেছ তা তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন।’ (সূরা আনআম : ৫৯-৬০)
‘তোমরা যদি কুফরি করো, তবে আল্লাহ তোমাদের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরি আচরণকে পছন্দ করেন না। আর যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা পছন্দ করেন। কোনো বোঝা বহনকারী অপর কারো বোঝা বহন করবে না। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে নিজেদের পালনকর্তার কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে তোমরা কী করছিলে তা জানিয়ে দেবেন। তিনি তো অন্তরের অবস্থা পর্যন্তও জানেন।’ (সূরা আল-জুুমার-৭)
‘তিনিই আকাশ ও জমিনকে ছয়টি নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশের উপর সমাসীন হলেন, যা কিছু মাটিতে প্রবেশ করে ও যা কিছু মাটি থেকে বের হয়, আর যা কিছু আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ও যা কিছু আকাশের দিকে উত্থিত হয়, তা সবই তিনি জানেন। তিনি তোমাদের সাথে রয়েছেন যেখানেই তোমরা থাকো। যে কাজই তোমরা করো, আল্লাহ তা দেখছেন। তিনিই আসমান ও জমিনের নিরঙ্কুশ সার্বভৌম মালিকানার একমাত্র অধিকারী। সব ব্যাপারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মীমাংসা সাধনের জন্যে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হয়। তিনিই রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর অন্তরের গোপন প্রচ্ছন্ন তত্ত্বও তিনি জানেন।’ (সূরা আল-হাদিদ : ৪-৬)
আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং সবকিছু শোনেন। তাহলে তাঁর দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে পালিয়ে থাকার উপায় কী? আর তিনি শুনতে না পান এভাবে লুকিয়ে কথা বলার জন্যই বা যাবে কোথায়?
এমতাবস্থায় আল্লাহর অবাধ্যতা করার চেয়ে তাঁর সব আদেশ নিষধ মেনে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু দেখা আর শোনা কেন, আল্লাহ আলিমুল গায়েব হিসেবে সবকিছু জানেন, এমনকি মানুষের অন্তরে জাগ্রত চিন্তাভাবনা পর্যন্ত তিনি জানেন।
মহান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করলে কোনো লোক তাঁর জ্ঞানের আওতার বাইরে গিয়ে পালিয়ে থাকার উপায় আছে বলে মনে করতে পারে কি? সহজে বিশ্বাস করতে যার কষ্ট হয় তার জন্য এর বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণ পেশ করা যায়, তবে আল্লাহ যাকে হেদায়াতের মহান দৌলত দান করেন না, সে প্রকাশ্য সত্যকেও অস্বীকার করে থাকে।
লেখক :
শিক্ষাবিদ ও গবেষক