পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ঊর্ধ্বগতিতে বেড়েই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, প্রধান প্রধান শহর অবরুদ্ধ করা, এমনকি সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আক্রান্ত দেশগুলোতে।
চীনের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এশিয়ার দেশগুলোতে কম বিপর্যয় হয়েছে। চীনের নিকটবর্তী দেশ হয়েও ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা ও আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনায় প্রশংসা কুড়িয়েছে সিঙ্গাপুর,হংকং,দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে দেশগুলোতে নেওয়া ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ যা অন্য দেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে- এমন সব বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ।
শিক্ষা–১: বিষয়টিকে গুরুত্ব দিন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিন
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে কিছু বিষয়ে একই পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে- করোনা পরীক্ষার পরিধি বাড়ানো, আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা রাখা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে উৎসাহিত করা। এই পদক্ষেপগুলো পশ্চিমা দেশগুলোতেও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে যত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল তা নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা নীতিবিষয়ক সাবেক পরিচালক তিক্কি প্যানগেস্তো বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ হারিয়েছে। চীনে ভাইরাসটি ছড়ানোর পর তারা দুই মাস সময় পেয়েছিল। অথচ তারা এমন একটি ভুল ধারণা পোষণ করে ছিল যে চীন তো অনেক দূরে এবং কিছুই হবে না।’
প্রথম দিকে করোনাভাইরাসকে রহস্যজনক উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, এটা সার্সের মতো আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে নিউমোনিয়া ঘটাতে পারে। এ ছাড়াও ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে না বলেও ধারণা করা হয়েছিল। ওই সময় ভাইরাসটি সম্পর্কে পুরো বিশ্ব অজ্ঞাত থাকলেও ওই অবস্থাতেই তিন দিনের মধ্যে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকং তাদের সীমান্তে স্ক্রিনিং শুরু করে। উহান থেকে আসা যাত্রীদের পরীক্ষা করা শুরু করে তাইওয়ান।
পরে ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারে, উপসর্গ নেই—এমন ব্যক্তিরাও এই ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। তাই পরীক্ষা করা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শিক্ষা–২: পরীক্ষাগুলো ব্যাপক ও সাশ্রয়ী করুন
দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় নাগরিকদের ব্যাপকভাবে পরীক্ষা শুরু করে। এখন পর্যন্ত দেশটি ২ লাখ ৯০ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করেছে। প্রতিদিন দেশটি বিনা মূল্যে ১০ হাজার লোকের পরীক্ষা করছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের সংক্রামক রোগের উদ্ভব বিষয়ের অধ্যাপক ওই ইং ইয়ং বলেছেন, তারা (দক্ষিণ কোরিয়া) যেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং লোকজনকে পরীক্ষা করেছে, তা উল্লেখ করার মতো।
সংক্রামক ব্যাধির পরীক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ায় যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া রয়েছে। ২০১৫ সালে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম প্রাদুর্ভাবে দেশটির ৩৫ জন মারা যাওয়ার পর তারা এই দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া কার্যকর করে।
অধ্যাপক প্যানগেস্তো জানান, কিছু দেশে পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট কিট নেই। তিনি বলেন, ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করার বিষয়টি এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেতে হবে। উপসর্গ রয়েছে, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়নি এবং এখনো ভাইরাস ছড়াচ্ছেন, এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা আরও বেশি জরুরি।
শিক্ষা–৩: শনাক্ত ও পৃথক করুন
যাদের উপসর্গ রয়েছে, শুধু তাদের পরীক্ষা করাই যথেষ্ট নয়। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে, তাদের শনাক্ত করুন। সিঙ্গাপুরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সংস্পর্শে আসা এমন ছয় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছিল। তাদের পরীক্ষা করা হয় এবং সেলফ আইসোলেশনে (বাড়িতে আলাদা থাকা) থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়, যতক্ষণ না পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে।
এ ছাড়াও কোয়ারেন্টিন বা সেলফ আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের দিনে কয়েকবার করে কর্তৃপক্ষকে ছবি পাঠিয়ে তার অবস্থা সম্পর্কে জানাতে হয়েছে। দেশটিতে নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
হংকংয়ে উপসর্গ রয়েছে—এমন ব্যক্তির সঙ্গে গত দুদিনে কারা মেলামেশা করেছে, তা শনাক্ত করা হয়। বাড়িতে আলাদা থাকার নির্দেশ পাওয়া ব্যক্তিরা কোয়ারেন্টিন যথাযথভাবে মেনে চলেছেন কি না তাও নিশ্চিত করা হয়। হংকংয়ে বিদেশ থেকে নতুন আগত ব্যক্তিদের গতিবিধির ওপর নজরদারি রাখার জন্য ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট পড়ানো হয়।
শিক্ষা–৪: সামাজিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখুন
করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধে সামাজিক মেলামেশা বন্ধ রেখে দূরত্ব বজায় রাখা অন্যতম কার্যকর একটি উপায়। চীনের উহান থেকে এই ভাইরাসের যাত্রা শুরু। সেখানে শাটডাউনের আগে ৫০ লাখ মানুষ উহান ছেড়ে যায়। এর ফলে চীন সরকার মানব–ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা কার্যকর করে।
তবে সিঙ্গাপুরে গণজমায়েত নিষিদ্ধ হলেও স্কুলগুলো চালু আছে। হংকংয়ে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে অবশ্য রেস্তোরাঁ ও পানশালাগুলো খোলা আছে।
গণজমায়েত নিষিদ্ধ বা স্কুল বন্ধ করে সামাজিক মেলামেশা বন্ধের বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তবে জনগণ কতটা সানন্দে এই উদ্যোগে অংশ নেয় সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই ব্যক্তিগত আচরণ, জনগণের সমষ্টিগত আচরণ এই দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা–৫: জনগণকে ভালোভাবে অবহিত করুন এবং পাশে থাকুন
অধ্যাপক প্যানগেস্তো বলেছেন, জনগণের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলে সরকারের কর্মকৌশল কোনো কাজে আসবে না। বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে কর্মকৌশল ঠিক করা হয়েছে, জনগণকে সে বিষয়ে অবহিত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।
অধ্যাপক ওই বলেন, দুর্যোগে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি স্বচ্ছ হতে হবে, যাতে মানুষ আতঙ্কিত হওয়ার বদলে আশ্বস্ত হতে পারে।
কয়েকটি দেশের সরকার বাসিন্দাদের বিস্তারিত তথ্য হালনাগাদের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। হংকং করোনাভাইরাসে আক্রান্তের প্রতিটি ঘটনা অনলাইনে সংরক্ষণ করছে। কোন কোন ভবনে আক্রান্ত ব্যক্তির বাস, সেটিও ম্যাপ করছে তারা। কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি স্থানে কেউ অবস্থান করলে তাকে সতর্ক করে মোবাইলে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
করোনাভাইরাসের বিস্তার মোকাবিলায় সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগকালে জনগণ সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যমও সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করছে।
শিক্ষা–৬: ব্যক্তিগত জীবনাচরণেও নজর দিতে হবে
এশিয়ার বাসিন্দারা সরকারের নির্দেশ বেশি মানে—এমনটা অনেকেই বলেন। তবে এটা খুবই সরলীকরণ একটি বক্তব্য। হংকংয়ে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বেশ কম। দেশটির নাগরিকদের সচেতনতার কারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় সরকার। বিশ্বের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মধ্যে মেলামেশা বন্ধ করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন। অনেকেই চান্দ্রবর্ষ উদ্যাপন থেকে বিরত ছিলেন, অংশ নেননি বড়দিনের আয়োজনেও।
অধ্যাপক প্যানগেস্তো মনে করেন, হংকংয়ের বাসিন্দারা সরকারকে আস্থায় না নিলেও তারা হংকংবাসী হিসেবে গর্ববোধ করেন। আর এই দুর্যোগকে তারা তাদের নাগরিক পরিচয়ের ওপর আঘাত বলে বিবেচনা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশগুলো যত বেশি আগ্রাসী পদক্ষেপ নেবে, ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার হারও তত কমে আসবে। এরপরও চোখ রাখতে হবে যেসব দেশ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তাদের পরবর্তী অবস্থা এখন কেমন। যেমন সীমান্ত দিয়ে ফেরা লোকজনের কারণে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও হংকং এখন দ্বিতীয়বারের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। এটা এখনো স্পষ্ট নয় যে মহামারিটি কত দিন চলবে।