সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ‘বেলা চাও’ গানটি। একসময় ইতালির এই লোকসংগীত ধানখেতের মহিলা শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে গাওয়া হতো। পরে তা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। প্রতিবাদের সেই গান মানুষকে এখন সাহস জোগাচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ করছে। করোনা আতঙ্ককে অনেকে বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোর সঙ্গে তুলনা করছেন। কিন্তু তার মধ্যেও কিছু আশার খবর তো আছেই।
ধরুন, ইউরোপের অন্যতম পর্যটন শহর ইতালির ভেনিসের কথা। গত বছরও ভেনিস পর্যটক এসেছিল আড়াই কোটি। প্রতিদিন লাখখানেক পর্যটক নিয়ে ভেনিসের খাল, লেক উথাল-পাথাল করে বেড়ায় ছোট–বড় ইঞ্জিনচালিত জাহাজ, স্পিডবোটসহ ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো। এর ফলে ভেনিসের খালের পানি ঘোলা, সেখানে আর মাছ দেখা যেত না। ভেনিসকে রক্ষা করতে স্থানীয় বাসিন্দারা আন্দোলন করছেন অনেক দিন ধরে। কেউ পাত্তা দেয়নি। কারণ, শুধু ভেনিসের পর্যটন থেকে ২০০ কোটি ইউরো ইতালি আয় করে। করোনা ভাইরাস ইতালিতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভেনিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর তাতেই ফিরতে শুরু করেছে ভেনিসের খালের চেহারা। মাত্র কদিনেই ভেনিসের পানি নীল স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। জল এতটাই স্বচ্ছ ও নীল যে মাছও দেখা যাচ্ছে। এমন স্বচ্ছ পানি ভেনিসের জনগণ শেষ কবে দেখেছেন, তা মনে করতে পারছেন না। মহামারীর এই সময় ‘মানুষের পাশে মানুষ’ এমন বার্তাও ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে।
ইতালির ভেনেতো অঞ্চলের শহর ভো। বিখ্যাত ভেনিস নগরী থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহরটির জনসংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৩০০। ইতালির একেবারে মাঝখানে শহরটি। গত ফেব্রুয়ারিতে ইতালির অন্যান্য এলাকার মতো ভো শহরেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা শনাক্ত করা হয় এই শহরেই। ২৩ ফেব্রুয়ারি। ৭৮ বছর বয়সি এক ব্যক্তি মারা যান। করোনা ভাইরাসের জন্য এই শহরকেই সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক এলাকা’ (রেড জোন) হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৩ মার্চ থেকে সেখানে নতুন কোনো সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। ইতালির অন্যান্য অঞ্চলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত ও সংক্রমণের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, সেখানে ভো কোনো খবরেই নেই।
কীভাবে এই বিস্ময়কর অগ্রগতি সম্ভব হলো? স্থানীয় প্রশাসন বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর শহরের সব বাসিন্দার করোনা পরীক্ষা করেন তারা। সবাইকে পরীক্ষা করা হয়। আর তাতেই মেলে সুফল। ভেনেতোর আঞ্চলিক প্রশাসন ও রেডক্রস কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে এই কাজটি করেন ভেনেতোর ইউনিভার্সিটি অব পাদুয়ার গবেষকরা। পাদুয়ার অণুজীববিজ্ঞানের অধ্যাপক আন্দ্রেয়া ক্রিসান্তি এবিসির দ্য ওয়ার্ল্ড টুডেকে বলেন, ‘আমরা সবাইকে পরীক্ষা করেছি। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করি। মোট বাসিন্দার ৩ শতাংশ (৮৯ জন) মানুষের শরীরে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। কোনো লক্ষণ নেই, এমন মানুষের শরীরেও করোনা শনাক্ত করা হয়। ভো শহরে সংক্রমণের হার দেখে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি ইতালির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। তাই যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাড়িতেই কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়। অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশার বিষয়ে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা।’ আর তাতেই মেলে সাফল্য। অধ্যাপক ক্রিসান্তি জানান, করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর সঠিক উপায় হচ্ছে পরীক্ষা আর আইসোলেশন। তবে গণহারে পরীক্ষা করার কাজ খুবই কষ্টসাধ্য বলেও স্বীকার করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইতালি ভাইরাস মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিলেও সময়মতো নিতে পারেনি। আবার সব পদক্ষেপের মধ্যে সমন্বয়ও ছিল না। তারা প্রথমে কোনো একটি শহরকে লকডাউন করেছে, এরপর করেছে একটি অঞ্চলকে এবং সবশেষে গোটা দেশকে। অর্থাৎ ভাইরাস যত ছড়িয়েছে, তারা তত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে আরো বেশি এলাকাজুড়ে। সব সময় তারা ছুটেছে ভাইরাসের পিছু পিছু। ভাইরাসের আগে যেতে পারেনি।
সূত্র : বর্তমান