হাছন রাজার কত কত গান! কত গল্প তাঁকে নিয়ে। বর্ণিল, বৈচিত্র্যময় ঘটনাবহুল তাঁর জীবন। হাছন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার একজন সামন্তপ্রভু ছিলেন। পিতা ও মাতা উভয়ের কাছ থেকে পাওয়া বিশাল জমিদারির মালিকানা চলে আসে কিশোর বয়েসে । অর্থ, বেহিসাবি সম্পদ আর ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। জাগতিক লোভ লালসা, ক্ষমতায়ন, জবরদখল করেও তিনি তাঁর প্রতিপত্তি বাড়ানোর কাজে প্রবৃত্ত ছিলেন । কিন্তু একসময় তাঁর ভেতরের ভ্রান্তি ঘুচে যায় । মধ্য পঞ্চাশে এসে তিনি ভিন্ন এক মানুষে পরিণত হয়ে যান । তাঁর বোধ হয় যে এ জগত সংসারের সকল অনাচারের মূলে আছে অতিরিক্ত সম্পদ। কিছুদিনের জন্য অতিথি হয়ে আসা মানুষেরা আসলে মহাশক্তির কাছে একেবারেই নশ্বর। তিনি তাঁর সম্পদ জনকল্যাণের জন্য উইল করে দিয়ে কয়েকজন সঙ্গিনীকে নিয়ে হাওরে হাওরে ভাসতে থাকেন আর এর মধ্যে খুঁজতে থাকেন সেই মহা পরাক্রমশালী স্রষ্ঠাকে। সৃষ্টি কর্তাকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় আবিষ্কার করেন, তাঁর নিজের মধ্যেই তাঁর বাস। তাঁর যে পিয়ারীকে সবাই হাছনজান বলে জানে, সে-ই আসল হাছন রাজা । জগতের মানুষের কাছে যিনি রাজা বলে চিনহিত ছিলেন, হাছন রাজার কাছে সে কেউই নয়, বরং পিয়ারী হাছনজানের ভেতরেই প্রকৃত হাছন রাজা বিরাজমান ছিলেন।
পহেলা অক্টোবর সন্ধ্যায় হাছন জানের রাজা মূর্ত হয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের জামাইকাস্থ পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে। বৃহত্তর ওয়াশিংটনের জনপ্রিয় নাট্যদল একতারা মঞ্চায়ন করেছে ‘হাছন জানের রাজা’। শাকুর মজিদের লেখা, শেখ মাওলা মিলনের পরিচালনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘হাছন জানের রাজা’। অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন রাচনা মিলন, কোরিওগ্রাফি ও নৃত্য পরিচালনা রোজমেরী মিতু রিবেইরো, সংগীত পরিচালনা কালাচাঁদ সরকার, সংগীত পরিচালনা নাসের চৌধুরী, বাঁশিতে বংশীবাদক মোহাম্মদ মাজিদ, তবলায় আশীষ বড়ুয়া, মন্দিরা সরোজ বড়ুয়া, পার্কাশন সুকুমার পিউরিফিকেশন এবং ঝিপিসিতে ছিলেন নীল।
হাছন জানের রাজার চরিত্রে অভিনয় করেন শেখ মাওলা মিলন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন শামীম চৌধুরী, আরিফুর রহমান স্বপন, মোহাম্মদ রাহমাতুল্লা, মীর দোজা, তিলক কুমার কর, হাসনাত সানি, আবু বকর সরকার, ছোটন বড়ুয়া, আফরিন ফেন্সি, আনিকা বড়ুয়া, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, ফাহমিদা হোসাইন, মোহাম্মদ আনোয়ার জামান, অহনাফুর রহমান, প্রজ্ঞা আহমেদ, সম্পদ পেরেরা, ও মুক্তা মেবেল রোজারিও। নৃত্যে ছিলেন পিটার, মেহেক, মেঘা, ঈশাল, সুকন্যা, এমিলি এবং মুজরা কোরিওগ্রাফি ও পরিবেশনায় ছিলেন রোকেয়া হাসি। কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছেন রুমানা সুমি চৌধুরী, শিখা আহমেদ, আতিয়া মাহজাবীন, জেসমিন আবেদীন এবং সাবরিনা রহমান।
নাটক মঞ্চায়নে শব্দ নিয়ন্ত্রনে ছিলেন জামিল খান, আলোক নিয়ন্ত্রণ প্যাট্রিক গোমেজ, মঞ্চসজ্জা উৎপল সাহা এবং সহযোগিতায় ছিলেন হারুনুর রাশিদ ও আহসান কবির। চিত্রাঙ্কন ও আল্পনায় ফাতেমা ফারজানা, ভিডিও সংযোজন তাহাসিন আলম, জজ সাহেব ভূমিকার পাশাপাশি আবহসংগীত সংযোজনে আরিফুর রহমান স্বপন, আবহসংগীত প্রাঙ্গনে মোর নাট্য দল, বাংলাদেশ , কস্টিউম ডিজাইন মেহেরুন নাহার, শামসুন নাহার এবং দিল্লী থেকে ভিনাই ভোলা ও সাতিন্দার কর। কস্টিউম সেটিং, ফিটিং এন্ড ব্যাক স্টেজ ম্যানেজমেন্ট রেহানা দোজা, সিফাত খান, সুজান গোমেজ , মোসাম্মত পারভীন, ও রওনক আজাদ। ফটোগ্রাফি রাজীব বড়ুয়া, তারেকুল হাসান চপল, আব্দুল হাফিজ, ও দেওয়ান বিপ্লব, ভিডিওগ্রাফিতে ছিলেন নুরুজ্জামান হামিদ শুভ এবং শেখ রাব্বানী।
এছাড়াও হাছন জনের রাজা মঞ্চায়নের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন খাইরুল ভূইয়াঁ পবন, মোহাম্মদ রহমান রিপন, তানজিন আলম, সৈয়দ আব্দুল হাই, ফারহানা হোসাইন, রিজওয়ানা কবির এবং শিমুল সাহা। ইশাত, মিথিলা, আনিকা, আসদিন, সারিম, সাফওয়ান, অংশুলা , হেমালি, মাহি, এডওয়ার্ড, ইউসফ, বুব্বা, সাফা, ফিলিপ, মোহামেদ, সামির প্রমুখ।
প্রগতিশীল ও লোকজ ধারার একনিষ্ঠ সংস্কৃতির চর্চার কেন্দ্র হিসাবে `একতারা’ প্রবাসের মাটিতে বিশেষ ভাবে বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রোপলিটন এলাকায় সংস্কৃতির বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের কথা বলে যাওয়া লোকজ সংস্কৃতির এতিহ্যাশ্রয়ী নাচ, গান, নাটক সহ সবকটি আনুষঙ্গিক অনুভূতির মাধ্যমগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা ও তার সংরক্ষণের নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে `একতারা’। একটি স্বীকৃত ৫০১ (সি)(৩) সংগঠন হিসাবে নিছক বিনোদনের বাইরেও সমাজের উন্নয়ন ও ঐক্যবদ্ধ সামাজিক শক্তির ধারাকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকে। `একতারা’ এদেশে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা সাংস্কৃতিক চর্চার জন্যে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম রূপে ভূমিকা রাখতে পেরে গর্ববোধ করে। লোকসংস্কৃতি প্রতি সকল মানুষের সহজাত ভালোবাসার শক্তিময় অভিব্যক্তি আমাদের একতারার সম্মুখপানে চলার অজেয় শক্তির উৎস।
লাউয়ের শুকনো খোলের এক তারবিশিষ্ট লোকবাদ্যযন্ত্র একতারার ঐন্দ্রজালিক সুরের মূর্ছনার মাঝে অবগাহন করে, বাংলার সোঁদা মাটির ঘ্রানে আবিষ্ট হয়ে, লোকসংস্কৃতির নাড়ির টানে আমাদের প্রিয় “একতারা” সংগঠনটির জন্ম। শুরু থেকেই আমাদের প্রচেষ্ঠা ছিল প্রবাসের মাটিতে বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে। ২০০৪ সালে একতারার প্রথম অনুষ্ঠান ছিল বাংলাদেশের জননন্দিত টিভি শো ‘ইত্যাদি’র আদলে লোক সঙ্গীত, আধুনিক ও লোকনৃত্য, ফ্যাশন শো, এবং কবি জসিম উদ্দিনের অনবদ্য কাব্যোপন্যাস “নকশী কাঁথার মাঠ” এর রূপাই ও সাজুর প্রেম কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নৃত্যনাট্য।
২০১০ সালে `একতারা’ ‘বায়োস্কোপ’ নামে একটি সফল প্রযোজনা করে যার প্রতিপাদ্য ছিল বাংলা চলচিত্রের রূপালী পর্দায় নানামুখী সামাজিক জীবনের সাংস্কৃতিক প্রতিফলনকে নিয়ে মঞ্চায়িত রূপ। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল আরব্য রজনীর অন্যতম নক্ষত্র বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় লোকগাথা “আলিবাবা ও চল্লিশ চোর” এর গীতি-নৃত্য-নাট্য রূপ।
২০১১ সালে একতারা লোক উৎসব’ আয়োজন করে যেখানে তুলে ধরা হয় কিংবদন্তী সাধক বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও তাঁর দর্শনের উপর ভিত্তি করে খ্যাতনামা লেখক শাকুর মজীদ রচিত “মহাজনের নাও” গীতল নাটকটির প্রশংসিত প্রযোজনা। ২০১৫ সালে একতারা লোকনাট্য রীতিতে মঞ্চায়িত করে বাংলাদেশের পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যযুগের কবি দ্বিজ কানাই রচিত ‘মহুয়া’ র পালা নাটকের ডাকাত সর্দার হুমরা বাইদ্যা, মহুয়া সুন্দরী আর নদ্যার চাঁদ এর ত্রিমুখী সাংঘর্ষিক অভিযাত্রার সফল মঞ্চায়নের মাঝে। ২০১৮ ‘সালে একতারা মঞ্চায়িত করে ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর গীতল পালা নাটক “চন্দ্রাবতীর”। একতারা পরিবেশিত জয়ানন্দ-চন্দ্রাবতীর বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনী “চন্দ্রাবতীর” মঞ্চায়ন প্রশংসিত হয়েছে নাট্য বোদ্ধা সহ সকল মহলে।
একালের মানস সরোবরের ভাবনায়, কল্পনায়, হাছনের বেপরোয়া জীবন এবং মায়ের মৃত্যুর পর জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, মরমি সাধক হয়ে ওঠার গল্প। একালে আমাদের অনেকের ভেতরে একজন ত্যাগী ও ভোগী, সংগীতপ্রিয় ও মাতৃভক্ত, আত্মানুসন্ধানী ও উদাসী বাউলা হাছন রাজা দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে বসত করে। জ্যামাইকার পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে গতানুগতিক ধারায় হাছন রাজার জীবনী তুলে ধরা হয়নি; বরং হাছন রাজা এসেছেন ভরা পূর্ণিমা রাতে। মাঝে মাঝে শোনা যেত যে হাছন রাজা সুরমা নদীতে মহা পূর্ণিমা রাতে দেখা দিতেন। তেমনই এক পূর্ণিমা রাত ছিল সেদিন যখন অনেকেই অপেক্ষা করছিলেন হয়তো বা আজও হাছন রাজা সুরমা নদীতে সবার সামনে দেখা দিবে। ঠিক তাই হয়েছিল হাছন রাজা ঠিক ঠিক দেখা দিয়েছিলেন সেদিন সে সুরমা নদীতে তার বজ্রা নৌকা নিয়ে। সেখানে আবর্তিত ছিল সব গ্রামের লোকজন আর আর তখন সেই হাসান রাজাকে দেখে তাদের কৌতুহলী মনের নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। আর তা দাড়িয়ে উত্তর করতে থাকেন হাসন রাজা এই নাটকের মাধ্যমে।
গান-সংলাপ-আলো-ছায়ায় বাংলাদেশে ভাটি অঞ্চল হয়ে উঠেছিল মঞ্চ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, লক্ষ্মণছিড়ি আর রামপাশা মিলিয়ে যে বিশাল ভাটি বা হাওর অঞ্চল, সেখানকার পাঁচ লাখ বিঘায় জমিদারি ছিল যাঁর, মঞ্চে দেখা যায় সেই দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী জমিদারের বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় জীবন। সেই জীবনের এক প্রান্তে হাছন রাজা অত্যাচারী প্রেমিক, স্বেচ্ছাচারী, বেখেয়ালি। অন্য প্রান্তে হাছন ত্যাগী, মানবদরদি। বিশাল জমিদারি ভাগ-বাঁটোয়ারার মাধ্যমে জনহিতকর কাজের জন্য ওয়াক্ফ করে পিয়ারীর সন্ধানে ভাওয়ালি নৌকায় উঠে বসা। যাঁর যাত্রার অন্তিম উপলব্ধি পিয়ারীর মাঝে নিজেকে এবং সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। নাটকের শেষে দেখা যায়, আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যেতে থাকেন হাছন রাজা। বাস্তবে ফিরে আসেন তরুণেরা, উপস্থিত দর্শকেরা।
নিউইয়র্কে বেশ বড় বড় কিছু অনুষ্ঠান সেদিন থাকা সত্ত্বেও ভার্জিনিয়া থেকে আসা নাটকটি হাউসফুল হয়ে ভীষণভাবে দর্শকদের কাছে সমাদৃত হয়। দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসায় ছিল নাটকের অভিনয়, নৃত্য, গান, শব্দ এবং আলোক সম্পাত। নাটকের প্রায় প্রতিটি সিনের শেষে দর্শকদের করতালি তাই মনে করিয়ে দিয়েছে বারংবার। নাটকের শেষে উপস্থিত দর্শক সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছে পুরো নাটকের টিমকে এত চমৎকার একটি পরিবেশনার জন্য।
নিউ ইয়র্কের জামাইকাস্থ পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে `হাছন জনের রাজা’র পরিবেশনা একতারার দ্বিতীয় মঞ্চায়ন। এর আগে নাটকটি বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসিতে মঞ্চায়ন করা হয় এবং দর্শক সমাদৃত হয়। বাংলা লোকসংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব ধ্রুবতারা মরমী সাধক হাছন রাজার জীবন কাহিনী নিয়ে একতারার এই নাট্য মঞ্চায়নে নিউ ইয়র্ক প্রবাসীদের উপস্থিতি ও সহোযোগিতা একতারাকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কর্ণধার শেখ ,মাওলা মিলন। একতারার পক্ষ থেকে সবার প্রতি ভালোবাসাময় একরাশ শুভেচ্ছা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।