পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু না জানা ও ভুল জানার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। আল্লাহর দ্বীন নিয়ে বাণিজ্যকারী কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মানুষকে বোকা বানাচ্ছে ও তাদের দুনিয়াবি ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে তথাকথিত হুজুর কিবলার জিকির করে মুশরিক হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা ব্যতীত মু’মিনের মুক্তি নেই। একমাত্র আল্লাহর জিকিরেই শান্তি ও আল্লাহর জিকিরেই পরিত্রাণ। তাফসির ফি জিলালিল কুরআনে আল্লাহর জিকির সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ইরশাদ হচ্ছে- ‘যারা ঈমান এনেছে ও তাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে পরিতৃপ্ত হয়ে গেছে। পরিতৃপ্ত হয়েছে এই অনুভূতির কারণে যে, আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে, এ কারণে এক নিরাপত্তাবোধ তাদের মধ্যে জমে গেছে। নির্লিপ্ত-নিশ্চিন্ত এই জন্য যে, তারা একদম একাকী নয় এবং তাদের পথ কোনো পেরেশানিতে ভর্তি নয়, তারা সৃষ্টির সবকিছুর ব্যবহার করে বুদ্ধিমত্তার সাথে ও তাদের জীবনের উদ্দেশ্য, প্রত্যাবর্তনস্থল সম্পর্কে তারা সঠিক চেতনা রাখে। তারা সব ধরনের দুঃখ থেকে নিশ্চিন্ত আর তারা মনে করে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনো মন্দ তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। বিপদ-আপদ যা-ই আসুক না কেন, সে অবস্থায় তারা বিচলিত হয় না; বরং অবিচল থাকে। এই নিশ্চিন্ত ও পরিতৃপ্তি মু’মিনের অন্তরের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ থাকার কারণেই সম্ভব হয়। এটিই হচ্ছে জিন্দেগির পরিতৃপ্তি, অন্তরের গভীরে গেঁথে থাকে এই তৃপ্তি, তারাই এটি পায় যাদের অন্তরের মধ্যে আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস বাসা বেঁধে আছে এবং তাদের গোটা অস্তিত্ব আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাসের (ঈমান) রঙে এমনভাবে রঞ্জিত যে, তাদের কোনো অবস্থাই বিচলিত করতে পারে না; কাজেই তারা আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িত। এ সম্পর্ক তারা বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে; কিন্তু এ সম্পর্কে যারা বোঝে না তাদের কোনো ভাষা দিয়ে এ কথা তারা বোঝাতে পারে না। কারণ এটি তো কোনো কথা নয়; এটি হচ্ছে অন্তরের এক বিশেষ অবস্থা- এটি অন্তরের মধ্যেই সৃষ্টি হয়, সেখানেই এটি লালিত পালিত ও মজবুত হয়। অবশেষে এ বিশ্বাস যাবতীয় ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে তুলে তাকে নির্লিপ্ত-পরিতৃপ্ত করে দেয়- এনে দেয় তার হৃদয়ে অনাবিল শান্তির অনুভূতি। আর তখন সে অনুভব করে যে, সৃষ্টির বুকে সে একা নয়, বান্ধবহীন নয়। আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে সৃষ্টির লীলাভূমি। সবাই তো এক আল্লাহর, তিনিই সবার সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা, তারই বান্দা ও অনুগত বান্দা হওয়ার কারণে সবাই তার প্রতি দরদি সহানুভূতিশীল।’
জীবনে এমনও কিছু মুহূর্ত আসে যখন মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়, আর তখন সে একমাত্র আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাঁর সহায়তার ওপর নিজেকে সোপর্দ করে সে নিশ্চিন্ত পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। এ সময় যতই শক্তিশালী, যতই দৃঢ়চেতা, যতই শক্তি সামর্থ্যরে অধিকারী সে হোক না কেন, সে বড়ই সঙ্কট বোধ করে, সে সময় আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ই তার থাকে না। এমন সময় একমাত্র মু’মিনের হৃদয়ই আল্লাহকে স্মরণ করার কারণে অন্য কারো পরোয়া করে না এবং সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন হয়ে যায়। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলেছেন- ‘আলাবি জিকরিল্লাহি তাতমা ইন্নুল কুলুব।’ অর্থাৎ- আল্লাহর স্মরণেই নির্লিপ্ত ও প্রশান্ত হয়ে যায় মন। (সূরা রাদ-২৮)
আল্লাহকে স্মরণ করার কারণেই পরিতৃপ্ত-নিশ্চিন্ত হতে পারে সে, যার কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের শেষ পরিণতি সুন্দর করে তোলেন এবং যত বেশি তারা আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকবে এবং যত বেশি জীবনের কাজগুলো সুন্দর করবে, তত বেশি তাদের হৃদয়ে নেমে আসবে নিশ্চিন্ততা, পরিতৃপ্তি, নিরুদ্বিগ্নতা ও নির্ভাবনা।
আল্লাহর জিকিরে মানুষের অশান্ত হৃদয় শান্ত হয়। সমস্যা-সঙ্কটে ভরা এই দুনিয়ায় শান্তি পেতে হলে আল্লাহর জিকির অনিবার্য ওষুধ বা নিয়ামক। কুরআন-হাদিসে বহু জায়গায় জিকিরের ফজিলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকরা মানসিক প্রশান্তির জন্য জিকিরের প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন। যেমন বলা হয়ে থাকে- ‘হার্ট বা হৃৎপিণ্ড মানুষের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হৃৎপিণ্ড সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘শরীরে একটি মাংসের টুকরো আছে, যার এ টুকরোটি সুস্থ থাকবে, তার পুরো শরীরই সুস্থ থাকবে। আর যার এ মাংসের টুকরোটি অসুস্থ হয়ে যাবে, তার পুরো শরীরই অসুস্থ হয়ে যাবে। আর তা সুস্থ রাখার উপায় হলো আল্লাহর জিকির।’ মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি হার্ট বা হৃৎপিণ্ড বর্তমান সময়ে অনেক বেশি রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। হার্ট বা হৃৎপিণ্ডের ব্যথা বা যেকোনো রোগের সম্মুখীন হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। তবে আল কুরআনে এই হৃৎপিণ্ড (কলব) ভালো রাখতে ও ব্যথামুক্ত রাখতে বিভিন্ন আয়াত রয়েছে। যারা নিয়মিত কুরআনের আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাদের হৃৎপিণ্ডের ব্যথাসহ যাবতীয় রোগব্যাধি দূর করে দেবেন।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার আল্লাহর জিকির করে আর যে করে না তাদের উদাহরণ হলো- জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (বুখারি-৭৪০৭)
রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন শতবার সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি পাঠ করবে তার গুনাহ যদি সমুদ্রের ফেনা পরিমাণও হয় তবুও আল্লাহ তায়ালা দয়া করে তা ক্ষমা করে দেবেন।’ (বুখারি-৬৪০৫)
হাদিসের গ্রন্থে জিকিরের অনেক মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে এ ব্যাপারে কিছু ভ্রান্ত মতবাদও রয়েছে, বলা হয়- অমুকের উছিলা দিয়ে জিকির করতে হবে; যেমন দয়াল বাবা-পাগলা বাবা প্রভৃতি। এসব ভণ্ডের কথা না শুনে আমাদের আল কুরআন ও হাদিসের কাছেই ফিরে আসতে হবে। কুরআনুল কারিম ও হাদিসে বিভিন্ন ধরনের দোয়া ও জিকির শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আরো উল্লেখ রয়েছে, আল্লাহ তায়ালার হামদ, তাসবিহ, তাহলিল, তাকবির ও আল্লাহর হাবিব সা:-এর প্রতি দরুদ পাঠ করার গুরুত্ব ও ফজিলত। আমাদের মনে রাখতে হবে- সালাত সিয়াম হজ জাকাত কোরবানি এসব নেককাজ সর্বোত্তম জিকির। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সময়ের অনেক রকম জিকির ও দোয়া। সেসব সহিহ আমল জেনে বুঝে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই সুন্দর হবে। মনে রাখা দরকার, আল্লাহর জিকির করতে হবে বিনয় ও নম্রতার সাথে; চিৎকার-চেঁচামেচি লাফালাফি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
আল্লাহর হাবিব প্রিয় নবী সা: জিকিরের আরো অনেক শব্দসম্ভার হাদিসে বর্ণনা করেছেন, যাতে মানুষ সঠিক পথ পেয়ে যায়। যেমন- রাসূলল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দিনে ১০০ বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি সাইয়িন কাদির পড়বে সে ব্যক্তি ১০টি দাস স্বাধীন করার সওয়াব পাবে, তার জন্য ১০০টি নেকি লেখা হবে এবং তার ১০০টি গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে তার রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তার চেয়ে উত্তম আর কেউ হবে না। তবে যে ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি পড়বে সে ব্যতীত।’ (বুখারি-৬৪০৩)
আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে পাপের পঙ্কিলতা থেকে অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়। আর স্বচ্ছ অন্তরে আল্লাহ তায়ালার কাছে কিছু চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না। মু’মিনের মূল চাওয়া হচ্ছে মাগফিরাত; অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তষ্টি; আল্লাহ তায়ালা পরম ক্ষমাশীল। এই ক্ষমা চাওয়ার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার। এ সম্পর্কে নবী সা: বলেছেন, ‘সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার হলো বান্দার এ দোয়া পড়া- ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের ওপর অটল আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।’ যে ব্যক্তি দিনে (সকালে) দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার পড়বে আর সন্ধ্যার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতি। আর যে ব্যক্তি রাতে (প্রথম ভাগে) দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এ দোয়া পড়বে, ভোর হওয়ার আগেই যদি মারা যায় সে জান্নাতি। (বুখারি-৬৩০৬)
লেখক :
সাংবাদিক