অনেকর ধারণা সংক্রমণ রোগের প্রকোপ মৌসুম বা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কমে যায়। অনেক রোগ শীতের মৌসুমে দেখা দেয়, যেগুলো আবার গরম শুরু হলে চলে যায়। টাইফয়েডের মতো অনেক রোগের শীর্ষ সময় গ্রীষ্ম। তাই অনেকে আশা করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে করোনাভাইরাসের বিস্তার কমে যাবে। কিন্তু মৌসুমি রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে যা কাজ করে, মহামারির ক্ষেত্রে অনেক সময় তা প্রযোজ্য হয় না। এ বিষয়ে আরও জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি ফিউচার।
গত বছর মধ্য ডিসেম্বরে চীনে ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হয়। সেসময় সেখানে শীত চলছিল। তখন অনেকেই আশা করতে শুরু করেন, গ্রীষ্মকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনার প্রকোপও কমে যাবে। কিন্তু এখন অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধরনের মতামতের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী জানাচ্ছেন। তাদের এ ধরনের সতর্কবাণীর পেছনে যুক্তিও রয়েছে।
করোনা ঋতুর সঙ্গে কতটা বদলাতে পারে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। তবে এটি মানুষের আচরণ, মেলামেশা, এক স্থানে কতো মানুষ অবস্থান করছে- এরকম আরও কিছু বিষয়ের ওপর বিস্তার নির্ভর করে। কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, যার আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয়েছে সার্ক-কোভ-২। এটি একেবারেই নতুন ধরনের একটি ভাইরাস, যা সম্পর্কে খুব কম তথ্য-উপাত্ত রয়েছে।
২০০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। আবহাওয়ার পরিবর্তন সেটার ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, সেই তথ্য এখনো জানা সম্ভব হয়নি।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস-এর পক্ষে কেট টেম্পলটনের চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুসে সংক্রমিত হয় এমন তিনটি করোনাভাইরাস শীতকালেই সংক্রমিত হয়েছে। এসব ভাইরাসের বিস্তার দেখা গেছে, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যেই। আরেকটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিছুটা বিক্ষিপ্ত প্রবণতা দেখা গেছে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে আগে ধারণা করা হচ্ছিল, এটাও হয়তো ঋতু ভিত্তিক একটি ভাইরাস। ধারণা করা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটি ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। যদিও উষ্ণ কয়েকটি দেশেও এর বিস্তার দেখা গেছে।
বিভিন্ন আবহাওয়ার বিশ্বের ৫০০ স্থান নিয়ে অপ্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ বিস্তারের ক্ষেত্রে ভাইরাস ও তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ এবং আর্দ্রতার সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ তাপমাত্রা কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার কমাতে পারে।
আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, নাতিশীতোষ্ণ উষ্ণ এবং ঠান্ডা জলবায়ু করোনার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এবার সমস্যা হলো, অনেক ক্ষেত্রে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগগুলো অন্যান্য ঋতুভিত্তিক রোগের মতো আচরণ করে না।
ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট অব স্টকহোমের ইনফেকশাস ডিজিজ কন্ট্রোলের অধ্যাপক জ্যান আলবার্ট বলেছেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাসটির ওপর তার প্রভাব পড়ে কিনা। আমরা নিশ্চিতভাবে সেটা জানি না। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে, এটা হতে পারে।’
কেন এমনটা আশা করছেন বিজ্ঞানীরা?
করোনাভাইরাস এমন একটি গোত্রের সদস্য যাদের বলা হয় ‘এনভেলপড ভাইরাস’। এর চারপাশে প্রোটিনের তৈরি একটা তৈলাক্ত আস্তরণ থাকে। যাকে বলা হয় লিপিড বাইলেয়ার। এ ধরনের অন্য ভাইরাসগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এরকম আবরণ থাকায় শরীরের বাইরে, মুক্ত পরিবেশে থাকা অবস্থায় উষ্ণ বা উচ্চ তাপমাত্রার আবহাওয়ায় ভাইরাস দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভাইরাসটি আরও টেকসই হয়ে ওঠে। রান্না করা মাংস ঠাণ্ডা করা হলে যেমন, চর্বির একটা আস্তর তৈরি হয়, অনেকটা তেমন। এ কারণেই তাপমাত্রা যত বাড়বে, করোনার বিস্তার ততো কমতে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস প্লাস্টিকের মতো শক্ত আবরণের ওপর ২১-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৪০ শতাংশ আর্দ্রতায় ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এবার কোভিড-১৯ ঠিক কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে এবং কী ধরনের আচরণ করে। তা নিয়ে এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
অন্যান্য করোনাভাইরাসের ওপর চালানো পরীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, কম তাপমাত্রায় অর্থাৎ চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মুক্ত পরিবেশে এগুলো ২৮ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।
স্পেনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল সায়েন্স ইন মাদ্রিদের গবেষক মিগুয়েল আরাজো বলছেন, ‘মানব শরীরের বাইরে ভাইরাসের ক্ষেত্রে জলবায়ু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভাইরাসটি যতক্ষণ মুক্ত আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারবে, ততক্ষণ সেটা অন্যদের সংক্রমিত করতে পারবে আর মহামারি হয়ে উঠতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনা বিশ্বব্যাপী বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এটি ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় বেশি বিস্তার হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মানুষের আচরণও অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।’
একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে থাকে। ফলে যেসব স্থানে মানুষ বেশি থাকবে, যত বেশি মেলামেশা করবে, সেখানে সংক্রমণের হারও বেশি হবে।
যদিও ঠাণ্ডা আবহাওয়ার দেশগুলোয় ভাইরাসের বিস্তার বেশি দেখা গেছে, কিন্তু গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতেও করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
এশিয়ায় ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসটির ওপর আবহাওয়ার প্রভাব যতটা ভাবা হয়েছিল কিন্তু প্রভাব তার চেয়ে কম।
তারা বলছেন, চীনের জিলিন ও হেইলংজিয়াঙ্গ এর মতো ঠান্ডা এলাকায় ভাইরাসটি যেমন বিস্তার করতে দেখা গেছে। তেমনি গুয়াংজি এবং সিঙ্গাপুরের মতো গ্রীষ্মপ্রধান এলাকাতেও সেরকম বিস্তার দেখা গেছে। সুতরাং বসন্ত বা গ্রীষ্মের মতো আবহাওয়া এই কোভিড-১৯ রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে ততটা কার্যকরী নয়।
ফলে তারা জনস্বাস্থ্য সতর্কতার বিষয়গুলো কার্যকরের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।