রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এমন একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে ২০২৪ সাল শুরু করেছেন, যাঁকে দেখে মনে হয় রেসলিং ম্যাচে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে ফেলেছেন।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান বীরদের শিরোপা প্রদান উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত পুতিনের নির্বাচনী প্রচারণায় মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। পুতিন বিশ্বাস করেন, এই সংঘাতের ফলাফল তাঁর পক্ষেই যাবে।
পুতিনের অতি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্যই ইউক্রেন নয়। ক্রেমলিন মনে করে, রাশিয়া পশ্চিমা সামরিক যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক মহাকাব্যিক সমরে অবতীর্ণ। পশ্চিমাদের বাসনা মেটাতে গিয়ে ইউক্রেন তাদের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বয়ানটি সত্যিকার অর্থে রাশিয়ার নেতারা বিশ্বাস করেন। এই বয়ান তাঁরা খুব সফলভাবে রাশিয়ার জনগণের ওপরও চাপিয়ে দিয়েছেন।
২০২৩ সালে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি, তবে কোনো ভূখণ্ডও তারা হারায়নি।
২০২৩ সালে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি, তবে কোনো ভূখণ্ডও তারা হারায়নি। অন্যদিকে উচ্চ প্রত্যাশাজাগানো ইউক্রেনের পাল্টা-আক্রমণ বড় কোনো অর্জন এবং কৌশলগত অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। ক্রেমলিনের আনন্দের বড় উপলক্ষ এটি।
রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে এবং পুতিনের জমানা অবসান হবে—এ রকম যে প্রত্যাশা অনেকে করেছিলেন, বাস্তবে সেটা ঘটেনি; বরং সামরিক ব্যয় বাড়ার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে এমন সচলতা তৈরি হয়েছে, যেটা আগে দেখা যায়নি।
রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৈশ্বিক জিডিপির গড় হারের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এ সময়ে মজুরি বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। রুশ অর্থনীতির এই অতি সচলতা উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে, কিন্তু সেটা খুব শিগগির ঘটবে না এবং উল্টে-পাল্টে দেওয়ার মতো কোনো বিপর্যয়ও হবে না।
পুতিন সরকার এখন আগের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। এই যুদ্ধ পুতিনকে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
ভাগনার গ্রুপের সশস্ত্র বিদ্রোহ পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেককে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ কোনো ফলই বয়ে আনতে পারেনি। এ নিবন্ধের লেখক তখন উৎসাহীদের এ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
এই যুদ্ধ পুতিনকে মোটেই দুর্বল করেনি। ভবিষ্যতে পুতিন দুর্বল হবেন, সেই আলামতও দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমা অভিজাতদের পক্ষে এটা হজম করা কঠিন। যুদ্ধে আনন্দ পান, এমন পশ্চিমা নেতারা সামরিক সমাধানের জন্য চাপ দিয়ে চলেছেন। এতে সংঘাত বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
গত মাসে বেলজিয়াম সেনাবাহিনীর প্রধান মিশেল হফম্যান বলেন, রাশিয়া এখন মালদোভা ও বাল্টিক দেশগুলোকে আক্রমণ করতে চায়। হফম্যানের সুরে সুর মিলিয়ে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দূত ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নিক্কি হ্যালি ৫ জানুয়ারি টুইট করেন, রাশিয়া পোল্যান্ডে হামলা করতে চায়।
এখন যুদ্ধ যেখানটাতে দাঁড়িয়ে, সেখানে যদি কোনো বন্দোবস্ত হয়, তাহলেও ইউক্রেনকেই চড়া মূল্য দিতে হবে।
ইউক্রেন তাদের ভূখণ্ড খুইয়েছে, ঘরবসতি ও অবকাঠামো চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখেছে, বিশাল অংশের ভূখণ্ড মাইন ও ক্লাস্টার বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ইউক্রেনের জনগণ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। তাঁদের হতাহতের সংখ্যাও অনেক, যা কিনা ইউক্রেন সরকার গোপন করে রাখতে চাইছে।
দশকের পর দশক ধরে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়নি, সেই বিতর্কিত প্রশ্নগুলো এখন আবার সামনে চলে এসেছে। যুদ্ধটা কি এড়ানো যেত না? এক বছরের যুদ্ধসজ্জার পর কোনো ঘটনা পুতিনকে সর্বাত্মক আগ্রাসনের পথে ঠেলে দিল? রাশিয়ার চাপের মুখে ভেঙে না পড়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতে কে সাহস জোগালো?
যুদ্ধের পক্ষের বিশ্লেষকেরা যেমনটা দাবি করেন, ইউক্রেন কি সত্যি সত্যি অস্তিত্ব-সংকটের মুখে পড়েছিল? ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার অলীক বাসনার কারণে অপূরণীয় মূল্য কি ইউক্রেনকে শোধ করতে হবে? জাতিগঠনের অধিকারের কথা বলে ইউক্রেন যেসব কর্মকাণ্ড করে (যেমন রুশ ভাষাকে জনপরিসর থেকে সরিয়ে দেওয়া, রাশিয়ান কবি ও কমিউনিস্ট বীরদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা) চলেছে, তার খেসারত কতটা মূল্য দিয়ে তাদের শোধ করতে হবে?
রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন যখন দ্বিতীয় বছরে এসে পড়ছে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো তাদের দেশের ভেতরের বিরোধিতার কারণে ইউক্রেনকে সহযোগিতা দিতে সমস্যায় পড়েছে।
এবারের নববর্ষের আগে-পরে রাশিয়া ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে। একের পর এক হামলা করে তারা ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্রেমলিন মনে করছে, এই হামলার মধ্য দিয়ে তারা ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দামি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিঃশেষিত করে ফেলতে পারবে।
পরিকল্পনা অনুয়ায়ী, রাশিয়া যদি সেটা করতে পারে, তাহলে যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালিয়েই ইউক্রেনের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। তাতে অন্যদের কল্পনার চেয়ে দ্রুত ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী একেবারে ভেঙে পড়বে।
সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ইউক্রেনের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। কয়েক দশক আগে শীতল যুদ্ধে শান্তিপূর্ণ (সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন) সমাধানের পর আবার সেই শীতলযুদ্ধ ফিরিয়ে এনে কী অর্জিত হলো পশ্চিমা মিত্রদের?
পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া নতুন ধরনের যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেটা আরও উত্তপ্ত হবে। ইউক্রেন, রাশিয়া ও পুরো ইউরোপের জন্য সৃষ্টি করবে নতুন ট্র্যাজেডি।