আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) একটি প্রতিবেদনে বলছে যে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে।
এতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চাকরি হারাতে যাচ্ছে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ। বর্তমানে বিশ্বের পূর্ণ বা খণ্ডকালীন মোট কর্মশক্তির প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পেশা কোনো না কোনোভাবে কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আমেরিকার দেশগুলোয় চাকরি হারাবে দুই কোটি ৪০ লাখ কর্মী, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় দুই কোটি (ইউরোপে এক কোটি ২০ লাখ), আরব দেশগুলোয় প্রায় ৫০ লাখ ও আফ্রিকায় এক কোটি ৯০ লাখ কর্মী।
আইএলও বলছে, বিভিন্ন আয়ের মানুষজন এর ফলে ক্ষতির শিকার হবে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
২০০৮-২০০৯ সালের বিশ্ব মন্দার সময় যত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, এই হার তার চেয়েও বেশি।
আইএলও-র তথ্য অনুযায়ী, আবাসন ও খাদ্যের পাশাপাশি নির্মাণ, খুচরা বিক্রি, ব্যবসা এবং প্রশাসনিক খাতগুলো বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বছর শেষে এই হার আরো বাড়বে কিনা, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যতে কী ধরণের উন্নয়ন ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তার ওপরে।
আইএলও মহাপরিচালক গাই রেইডার বলেছেন, উন্নত ও উন্নয়নশীল, সব দেশের ব্যবসা ও কর্মশক্তি চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। আমাদের যৌথভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন সঠিক আর দ্রুত ভিত্তিতে নেয়া পদক্ষেপই টিকে থাকা আর ভেঙ্গে পড়ার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে।”
কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ?
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, তার ৬৩ শতাংশ ইউরোপে যায়, বাকি ১৫ শতাংশ যায় আমেরিকায়। বলা যায়, বেশিরভাগ যাচ্ছে, ওই দুইটি বাজারে। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, মানুষজন ঘরের ভেতরে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু হওয়ার পর এখন ৩.২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হচ্ছে। তারা বলছে, হোল্ড করতে, সেটা একটা বিরাট ধাক্কা।”
তিনি জানান, গত বছরের মার্চ মাসের তুলনায় এবছর মার্চ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩০ শতাংশ কম। এপ্রিলে সম্ভাবনা রয়েছে, গত বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ রপ্তানি হারানো। আর এর সাথে ৪৫ লাখ চাকরি জড়িত।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলছেন, সরকারের মাধ্যমে তারা হয়তো আগামী তিনমাস সুরক্ষা পাবেন। জুন মাস পর্যন্ত।
“কিন্তু এটা সাময়িক একটা ব্যবস্থা। এরপরে কী হবে? ব্যবসা করতে না পারলে কোম্পানিগুলো কর্মী রাখবে কেমন করে?”
তিনি বলছেন, এর বাইরে অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে বড় একটি ধাক্কা হতে যাচ্ছে রেমিটেন্সে। সেখানে একটা বিরাট ধ্বস নেমেছে।
”বাংলাদেশের মূল বাজার মূলত তিনটি। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আরেকটা পূর্ব এশিয়া। প্রথম দুইটা বাজার খুব খারাপ হয়ে পড়েছে।
“এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সেখানে চাকরিচ্যুতি শুরু হয়ে গেছে। ফলে এসব দেশে বিপুল বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।”
এর মধ্যেই বিশ্বব্যাংক একটি পূর্বাভাসে বলেছে বাংলাদেশে এই বছর প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেন, এমন সংস্থাগুলো বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে এর মধ্যেই শ্রমবাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বলেছে, শতাধিক কারখানায় কর্মী ছাটাই করা হয়েছে।
বিবিসি জানতে পেরেছে, শুধু কর্মী নয়, অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরও স্বেচ্ছায় অন্তত ছয়মাসের ছুটিতে যেতে বলেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এই সময়ে তাদের চাকরি থাকলেও তারা বেতনভাতা পাবেন না।
করোনাভাইরাস জনিত পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে অঘোষিত লকডাউন শুরু হয়েছে, এর ফলে যারা হোটেল-রেস্তোরা, নির্মাণ খাতের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, সেসব খাতে শ্রমিকরা দীর্ঘদিন বেকার বসে রয়েছেন। অনেকেই বেতন ভাতা পাচ্ছেন না।
আর্থিক কারণে এরকম কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তখন সেটির শ্রমিকরা সেখান থেকে কোন আর্থিক সুবিধা পান না।
কর্মসংস্থানের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাবের বিষয়টি একেক দেশের শ্রমবাজারে একেকভাবে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষক পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
”প্রথমত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকি যত দীর্ঘায়িত হবে, ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর যত প্রভাব পড়বে, ততো শ্রম বাজারের ওপর প্রভাব পড়বে।”
তিনি বলছেন, ”বাংলাদেশের জন্য দুইটি ভিন্ন প্রেক্ষিত রয়েছে। আইনগতভাবে আনুষ্ঠানিক সেক্টরে শ্রমিককে ছাটাই করতে হলে তার পাওনা-ভাতা দিয়ে বিদায় করতে হয়। কিন্তু সেটা করার মতো মানসিক বা আর্থিক ক্ষমতা অনেক উদ্যোক্তার নেই।”
“তাই তারা চাইবেন বিকল্পভাবে ছুটি বা শ্রমিকের ভাতা কিছু কম দিয়ে সময়টা দীর্ঘায়িত করার। সেরকম কয়েকটি ঘটনাও সম্প্রতি আমরা দেখেছি।”
”আরেকটি হলো, সরকারের দিক থেকে যেহেতু সাহায্য সহযোগিতা এসেছে, এবং শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সেটা হচ্ছে, সুতরাং শ্রমিক ছাটাই বা বেতন কাটার ক্ষেত্রে সেটা উদ্যোক্তাদের বিমুখ করছে। সেটা এক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক দিক।”
”অন্যান্য দেশে শ্রম নিয়োজন বা ছাটাই একেবারেই বাজার ভিত্তিক হয়, তার তুলনায়, আমাদের আইনকানুন, সরকারের উদ্যোগ, উদ্যোক্তাদের আর্থিক ক্ষমতা- এসব মিলিয়ে আমাদের ধারণা আনুষ্ঠানিক সেক্টরে চাকরিচ্যুতি অতোটা ব্যাপকভাবে নাও হতে পারে।”
”কিন্তু ইনফর্মাল সেক্টর, যেমন পরিবহন, হোটেল রেস্তোরায় যারা কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো ততোটা জোরালো নয়। সেসব ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। আশার কথা হলো, তাদের জন্য সরকার একটি বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন। সেটা যদি ঠিকভাবে করা যায়, তাহলে হয়তো তাদের টিকে থাকার একটা অবলম্বন হবে।” বলছেন মি. মোয়াজ্জেম।
এছাড়া রপ্তানি বাজারের খারাপ অবস্থার কারণে দীর্ঘদিন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ভেতর থাকতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা কাজ হারাতে পারেন। এরপরেও খুচরা ব্যবসায়ের সাথে জড়িত শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। তবে খাতভিত্তিক চিন্তা করলে হোটেল রেস্তোরা, সেবা খাতের কর্মীরা বেশি কাজ হারাতে পারেন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর কর্মকর্তা নাজমা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, ”কোন জরিপ ছাড়াই আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করেন, করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতিতে তারা এর মধ্যেই বসে গেছেন। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন পার্লার, দোকান, ইত্যাদি বন্ধ হয়ে আছে। সেখানে একজন দুইজন করে যারা কাজ করেন, তাদের চাকরিও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।”
বিলসের মতে, বেশ কয়েকটি সেক্টর বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়বে। তার মধ্যে হোটেল, রেস্তোঁরা, নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়বে।
তবে বাংলাদেশের কতো শ্রমিক এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেই হিসাব এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থাগুলো।
সোমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ঘোষণায় জানিয়েছেন, দিনমজুর, রিক্সা বা ভ্যান চালক, মটর শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ যারা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন, তাদের নামের তালিকা ব্যাংক হিসাবসহ দ্রুত তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠতে পারবে?
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুএরে মতে, বাংলাদেশে কত দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে তা নির্ভর করবে রোগটা কতোটা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার ওপরে।
ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো আলাদাভাবে হবে। কারণ তাদের অর্থনীতি বা মূল আয়ের উৎস একরকম, বাংলাদেশর অন্যরকম।
করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বই একটা ধকলের মধ্যে পড়েছে। উন্নত দেশগুলোই যখন সংকটে পড়েছে সেখানে বাংলাদেশ কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে?
তিনি বলছেন, কীভাবে বা কতদিনে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে সেটা এখনি বলা যাবে না। আপাতত সরকার তিনমাসের জন্য সংকট সামাল দেয়ার একটা ব্যবস্থা নিয়েছে।
”আপাতত ছয়মাসের জন্য নানামুখী ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে অর্থনীতি রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে”, বলছেন মি. মনসুর।
”মানুষ কাজ করতেই চায়। তারা যাতে কাজ করতে পারে, ব্যবসা করতে পারে, সরকার ও সবাই মিলে পরিবেশটা তৈরি করতে হবে।”
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ”ইউরোপ-আমেরিকার বাজার যদি মন্দা থাকে, তাহলে বরং বাংলাদেশের জন্য পণ্য রপ্তানির বিকল্প বাজার আছে কিনা, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”
”সঙ্গে সঙ্গে পোশাক খাতের ক্রেতারা যাতে শ্রমিকদের এই চাকরির ঝুঁকির দায়িত্ব শেয়ার করতে রাজি হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকি সামলাতে দাতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে হবে, যাতে যতটা সম্ভব সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয় বলে পরামর্শ দিচ্ছেন মি. মোয়াজ্জেম।
”ব্যয় সংকোচন করে এবং বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে হলেও এই সময়ের জরুরি চাহিদার দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে যাদের দরকার, তাদের খাদ্য নিরাপত্তার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।”
সূত্র : বিবিসি