পৃথিবীতে যখন অন্যায়-অবিচার চরম আকার ধারণ করেছিল। মানবজাতি ছিল পথহারা, দিশেহারা। হেদায়েতের সব পথ সম্পর্কে অজ্ঞ। অশ্লীলতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও চরিত্রহীনতায় নিমগ্ন ছিল। শিরিক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। জাতির এমন চরম দুর্দিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সা:-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন এবং তার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেন। কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই জাহেল জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
এই কুরআনে কারিমের প্রতিটি সূরা, প্রতিটি আয়াত, এমনকি প্রতিটি হরফেও নেকি রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার কালাম হিসেবে পুরো কুরআন তুলনাহীন মর্যাদার অধিকারী। তবে আল্লাহ তায়ালা কোনো কোনো সূরা ও আয়াতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত ঘোষণা করেছেন।
এই বিশেষ ফজিলতের অধিকারী সূরাগুলোর অন্যতম হলো সূরা ইখলাছ। পবিত্র কুরআনের ১১২তম সূরা এটি। যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরায় তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সহিহ হাদিসে এই সূরার অনেক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।
শানে নুজুুল : কিছু ইহুদি নেতা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এসে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমার রব সম্পর্কে বলো এবং তার কিছু বিবরণ দাও।
আল্লাহ তায়ালা তাওরাতে তার পরিচয় তুলে ধরেছেন এবং কয়েকটি গুণাবলি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তুমি আমাদের বলো, তিনি কিসের তৈরি? কোন শ্রেণীভুক্ত তিনি? তিনি কি স্বর্ণ না রৌপ্য নাকি তাম্র? তিনি কি খাবার ও পানীয় গ্রহণ করেন?
পৃথিবীর উত্তরাধিকার তিনি কার থেকে পেয়েছেন আর তার উত্তরাধিকারীই বা হবে কে? এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা এ সূরা নাজিল করেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
সূরা ইখলাসের ফজিলত : ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ সূরা ইখলাস। এই সূরাকে যে ভালোবাসে আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।
আয়েশাহ রা: থেকে বর্ণিত- একবার নবী সা: এক ব্যক্তিকে একটি সেনাদলের সেনাপতি করে পাঠালেন। সে তার সঙ্গীদের সালাত আদায় করাত এবং ‘কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ’ দিয়ে সালাত শেষ করত। সেনাদল মদিনায় ফেরার পর তারা নবী সা:-এর কাছে এ কথা উল্লেখ করেন। তিনি বললেন, ‘তাকে জিজ্ঞেস করো কী কারণে সে তা করে।’ সে বলল, এর কারণ এতে আল্লাহর গুণাবলির উল্লেখ রয়েছে। আর আমি আল্লাহর গুণাবলি পড়তে ভালোবাসি। তার উত্তর শুনে নবী সা: বললেন, ‘তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহ তায়ালাও তাকে ভালোবাসেন।’ (বুখারি-৭৩৭৫)
এই সূরা কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান : সূরা ইখলাছ ছোট একটি সূরা। সবার জন্য পড়া সহজ। কিন্তু সাওয়াবের দিক থেকে তুলনাহীন। একবার পড়লে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতের সাওয়াব লাভ হয়।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- আবু সাইদ খুদরি রা: বলেন, নবীজী বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই কি প্রতি রাতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতে পারো না?’ বিষয়টি সাহাবিদের কাছে কঠিন মনে হয়। সুতরাং তারা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের মধ্যে কে আছে, যে তা পারবে? নবী করিম সা: বললেন, আমলটি সহজ। কেননা, সূরা ইখলাছই কুরআন মাজিদের এক তৃতীয়াংশ। (সহিহ বুখারী, হাদিস-৫০১৬)
সূরা ইখলাস তিলাওয়াকারীর গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয় : আবুল হাসান মুহাজির রাহ. বলেন, জনৈক সাহাবি বর্ণনা করেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে এক সফরে ছিলেন। (একদিন তাঁর কাছে এমনভাবে বসা ছিলেন যে) তার দুই হাঁটু নবীজীর হাঁটুদ্বয়ের সাথে লেগে ছিল।
এ অবস্থায় এক লোককে শুনলেন, সূরা কাফিরুন তিলাওয়াত করছে। তা শুনে নবী সা: বললেন, ‘সে শিরক থেকে পবিত্র হয়ে গেছে। আরেক লোককে শুনলেন, সূরা ইখলাছ তিলাওয়াত করছে। তখন তিনি বললেন, তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ-২৩২০৬)
সূরা ইখলাস পাঠকারীর জন্য জান্নাতে অট্টালিকা নির্মাণ করা হবে : আল্লাহর ভালোবাসা ও নিয়ামতে ভরপুর জান্নাতের প্রাসাদ পেতে নিয়মিত সূরা ইখলাসের আমল করা জরুরি। নিয়ামতে ভরপুর জান্নাতের অট্টালিকা পেতে সূরা ইখলাসের আমল অতীব জরুরি।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ইখলাস ১০ বার পড়বে তার জন্য জান্নাতে একটি অট্টালিকা নির্মাণ করা হবে। যে ২০ বার পড়বে তার জন্য দু’টি অট্টালিকা তৈরি করা হবে। আর যে ৩০ বার পড়বে তার জন্য তিনটি অট্টালিকা প্রস্তুত করা হবে। নবীজীর এ কথা শুনে উমর ইবনে খাত্তাব রা: বললেন, তাহলে তো আমরা অনেক অট্টালিকার মালিক হয়ে যাব। রাসূলে করিম সা: বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালার দান এর চেয়ে আরো প্রশস্ত।’ (সুনানে দারেমি, হাদিস-৩৪৭২)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সূরা ইখলাসের বেশি বেশি পড়ার তাওফিক দান করুন, আমিন!
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা