সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন

করোনার জীবাণু গবেষণাগার থেকেই ছড়িয়েছে, নাকি প্রাকৃতিক

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০২০
  • ২৬৯ বার

আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতরের তারবার্তায় দেখা যাচ্ছে চীনের উহানে একটি জীবাণু ল্যাবরেটরির জীবাণু সংক্রান্ত নিরাপত্তা নিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা চিন্তিত।

চীনের যে শহর থেকে বিশ্বের ১৮৫টি দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়েছে, ওই গবেষণাগারটি সেই উহান শহরেই অবস্থিত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই ভাইরাস একটি ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে গেছে এমন অসমর্থিত রিপোর্ট তার সরকার খতিয়ে দেখছে।

বর্তমান মহামারির পটভূমিতে এই ল্যাবরেটরি থেকে জীবাণু বেরিয়ে আসার অভিযোগ বা জল্পনা আসলে কতটা সঠিক?

ওই তারবার্তাগুলোয় কী আছে?
ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্র ওইসব কূটনৈতিক তারবার্তা থেকে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৮ সালে আমেরিকার বিজ্ঞানবিষয়ক কূটনীতিকদের চীনের ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কয়েকবার সফরে পাঠানো হয়।

ওই কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে দু’টি সতর্কবার্তা পাঠান যাতে ওই ল্যাবরেটরিতে নিরাপত্তার অভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

পত্রিকায় আরো বলা হয়, ওই কর্মকর্তারা উহান ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি (ডাব্লিউআইভি) নামে ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দুর্বলতার ব্যাপারে চিন্তিত, এবং এ ব্যাপারে তারা আরো সাহায্য চেয়ে তারবার্তা পাঠান।

এতে আরো বলা হয় ওই ল্যাবরেটরিতে বাদুড়ের করোনাভাইরাস নিয়ে যে গবেষণা চলছে তার থেকে সার্সের মতো মহামারির ঝুঁকি নিয়ে ওই কূটনীতিকরা উদ্বিগ্ন ছিলেন।

ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ওই তারবার্তাগুলোকে কেন্দ্র করে আমেরিকান সরকারে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে যে, বিশ্বের বর্তমান এই মহামারির কারণ উহানের ওই ল্যাবরেটরি অথবা সেখানকার অন্য আর কোনো ল্যাবরেটরির ভাইরাস কি-না।

পাশাপাশি আমেরিকার ফক্স সংবাদ চ্যানেলও এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ওই ল্যাবরেটরি বলে একটি তথ্য তুলে ধরেছে।

এই প্রাদুর্ভাবের খবর জানা যায় গত বছরের শেষ দিকে, যখন শুরুতে বলা হয় এই ভাইরাস উহানের একটি খাবারের বাজার থেকে এসেছে।

কিন্তু অনলাইনে এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা চললেও কোনো ল্যাবরেটরি থেকে Sars-CoV-2 ভাইরাস (যার থেকে কোভিড-১৯ রোগ হয়) দুর্ঘটনাবশত বেরিয়ে গেছে, এর পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ল্যাবরেটরিগুলোতে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবহার করা হয়?
যেসব গবেষণাগারে ভাইরাস এবং জীবাণু নিয়ে কাজ করা হয়, সেখানে বিএসএল মানদণ্ডের নিরাপত্তা ব্যবহার করা হয়। বিএসএল দিয়ে জীবাণুবিষয়ক নিরাপত্তার মান বোঝানো হয়।

এই মানদণ্ডের চারটি ধাপ আছে। এগুলো নির্ভর করে কী ধরনের জীবাণুর রসায়ন নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে এবং সেগুলো আলাদা অবস্থায় নিরাপদে রাখতে ক’ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

বিএসএল-১ ধাপটি সবচেয়ে নিচু মাত্রার এবং ব্যবহার করা হয় সেইসব ল্যাবরেটরিতে যেখানে পরিচিত সেইসব জীবাণু নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, যেসব জীবাণু মানুষের জন্য ঝুঁকির নয়।

সর্বোচ্চ ধাপ অর্থাৎ বিএসএল-৪ ব্যবহার করা হয় সেইসব গবেষণাগারে যেখানে এমন জীবাণু নিয়ে কাজ করা হচ্ছে যার ক্ষেত্রে চরম সতর্কতার প্রয়োজন। অর্থাৎ চরম বিপজ্জনক জীবাণু যার মোকাবেলায় টিকা বা চিকিৎসা প্রায় নেই। যেমন ইবোলা, মারবার্গ ভাইরাস এবং আমেরিকা ও রাশিয়ায় শুধুমাত্র দুটো ল্যাবরেটরিতে গুটিবসন্তের ক্ষেত্রে।

একই বিএসএল মান আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, যদিও দেশভেদে সামান্য কিছু তফাৎ থাকতে পারে।

‘যেমন রাশিয়ায় সর্বোচ্চ সুরক্ষাসম্পন্ন গবেষণাগারকে বিএসএল-১ হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়। আর সবচেয়ে কম মাত্রার সুরক্ষা যেসব গবেষণাগারে প্রয়োজন, সেগুলো বিএসএল-৪ হিসাবে চিহ্ণিত করা হয় – একেবারে বিপরীত নম্বরের খাতিরে, কিন্তু যে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা মানের ক্ষেত্রে একেবারে এক,’ বলছেন লন্ডনে কিংস কলেজের জৈব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. ফিলিপা লেন্তজস।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন ধাপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে, কিন্তু নির্ধারিত মান কোনোরকম চুক্তির মাধ্যমে বলবৎ করা হয়নি।

‘এগুলো তৈরি করা হয়েছে কাজের পরিবেশ নিরাপদ রাখার স্বার্থে, যাতে ল্যাবরেটরিতে যারা কাজ করছেন তারা নিজেরা সংক্রমিত না হন এবং তাদের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের সংক্রমিত না করেন, এবং যাতে করে ল্যাবরেটরি থেকে জীবাণু দুর্ঘটনাবশত বাইরে চলে না যায়,’ বলছেন ড. লেন্তজস।

তবে তিনি বলছেন, ‘কেউ যদি আন্তর্জাতিক পার্টনারশিপে কোনো একটা প্রকল্পে কাজ করে, তাহলে সেই প্রকল্পের অধীন ল্যাবরেটরিগুলোকে একটা নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যদি সেই প্রকল্পে আন্তর্জাতিক অর্থ সাহায্যের ব্যাপার থাকে।’

উহানের ডব্লিউআইভি আমেরিকার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদান নিয়ে কাজ করছিল। আর সে কারণেই ওই তারবার্তায় উহানের গবেষণা কেন্দ্রকে আরো সহায়তা দেবার সুপারিশ করা হয়েছিল।

তারবার্তায় কীধরনের নিরাপত্তা দুর্বলতার কথা বলা হয়েছিল?
আসলে, ওয়াশিংটন পোস্টের খবর থেকে সেটা জানা যায়নি। তবে সাধারণভাবে বলতে গেলে জৈব কোনো পদার্থ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করার নিরাপত্তা লংঘনের ঘটনা ঘটতে পারে বেশ কয়েকটি উপায়ে।

ড. লেন্তজস্-এর মতে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘ওই গবেষণাগারে কাদের প্রবেশাধিকার আছে, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ, তথ্য নথিভুক্ত করার পদ্ধতি, সাইন বসানো, জীবাণুর নমুনার হিসাব রাখা, দুর্ঘটনা ঘটলে তা জানানোর পদ্ধতি এবং আপদকালীন ব্যবস্থা – এসবের মাধ্যমে।’

কূটনৈতিক তারে উদ্বেগ প্রকাশ কতটা অস্বাভাবিক ব্যাপার?
দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। ২০১৪ সালে ওয়াশিংটনে একটি গবেষণা কেন্দ্রের কাছে একটি কার্ডবোর্ড বাক্সে গুটিবসন্তের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো ভুলে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল।

মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১৫ সালে দুর্ঘটনাবশত দেশের প্রায় ১০টি ল্যাবরেটরিতে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে জীবন্ত অ্যানথ্র্যাক্স জীবাণুর নমুনা পাঠিয়েছিল।

অনেক দুর্ঘটনা ঘটে যায় কম ধাপের সুরক্ষা সম্বলিত অনেক ল্যাবে – যেগুলো খবরে আসে না।

কিন্তু বিএসএল-৪ অর্থাৎ সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ল্যাবরেটরির সংখ্যা পৃথিবীতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম – উইকিপিডিয়ার হিসাবে মাত্র ৫০টি, আর উহানের ওই গবেষণা কেন্দ্র তার একটি।

এই গবেষণা কেন্দ্রগুলো তৈরি করতে হয় খুবই সতর্ক ব্যবস্থা নিয়ে – খু্বই উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে। কারণ এগুলোতে এমন জীবাণু নিয়ে কাজ হয়, যেগুলো বিজ্ঞানের নিরীখে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবাণু।

ফলে এসব ল্যাবরেটরিতে নিরাপত্তার মান রাখতে হয় খুবই উঁচু। কাজেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পান থেকে চুন খসলে তা নিয়ে তৈরি হয় উদ্বেগ।

আগেও তো ল্যাবরেটরি থেকে ভাইরাস বাইরে চলে আসার কথা এসেছে?
হ্যাঁ। নভেল করোনাভাইরাসের খবর জানার সাথে সাথেই জল্পনা শুরু হয় এর উৎস নিয়ে। যদিও এসব উৎস সম্পর্কিত তথ্য ছিল অসমর্থিত।

জানুয়ারি মাসে অনলাইনে যে তথ্যটি ভাইরাল হয়, তাতে বলা হয় এই ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে ল্যাবরেটরিতে জীবাণু অস্ত্রে ব্যবহারের জন্য। তবে বিজ্ঞানীরা এই অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, প্রাণী থেকে, খুব সম্ভবত বাদুড় থেকে, এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজেও ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস তৈরি করা হয়ে থাকে। যেমন, কোনো জীবাণুর আচরণ নিয়ে গবেষণার কাজে – যেখানে বিজ্ঞানীরা দেখতে চান ভবিষ্যতে কোন জীবাণুর জেনেটিক গঠন কীভাবে বদলাতে পারে, যাতে করে তা প্রতিরোধের উপায় বের করা যায়।

কিন্তু করোনাভাইরাসের জিনোম নিয়ে একটি গবেষণার রিপোর্টে – যেটি মার্চ মাসে আমেরিকায় প্রকাশিত হয় – কোন ল্যাবরেটরিতে এ রকম জীবাণু তৈরির কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি।

‘যেসব জিনোম তথ্য আমাদের হাতে আছে তার থেকে পরিষ্কারভাবে বলা যায়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে, কোনো ল্যাবে নয়,’ বলেন ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন, যিনি এই নতুন ভাইরাসের কথা প্রকাশ পাওয়ার সময় ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চ সেন্টারে গবেষক ছিলেন।

এরপর অভিযোগ আসে ল্যাব থেকে এই ভাইরাস দুর্ঘটনাবশত বাইরে চলে এসেছে।

উহানে সামুদ্রিক মাছের বাজার, যেখান থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তার খুব কাছেই উহানের অন্তত দুটি গবেষণা কেন্দ্র আছে, যেখানে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণার কাজ হয়। ফলে এই দু’য়ের যোগাযোগ নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে।

উহানের ডব্লিইআইভি কেন্দ্রটিতে বাদুড়ের করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছিল – সেটা সবাই জানে। এই গবেষণার কাজ পুরোপুরি বৈধ ছিল এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে এই গবেষণার খবর ছাপাও হয়েছে।

২০০০-এর দশকে সার্সের প্রাদুর্ভাব নিয়ে চীনের অভিজ্ঞতার পর এই গবেষণায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

ড. লেন্তজস্ বলছেন, এই ভাইরাসের উৎস কোথায় তা ‘খু্বই কঠিন প্রশ্ন’।

তিনি আরো বলেছেন যে, ‘পর্দার আড়ালে জৈব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অনেক কথাবার্তা বলেছেন, এবং সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকে এই ভাইরাস এসেছে বলে চীন খুবই জোর দিয়ে যে দাবি করেছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।’

কিন্তু এই মুহূর্তে এমন কোনোই তথ্যপ্রমাণ নেই যে, উহানের কোনো গবেষণা কেন্দ্র থেকে এই Sars-CoV-2- ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা অনেকবার বলেছেন ‘নতুন করোনাভাইরাস কোনো ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।’

ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে করোনাভাইরাস মহামারির মোকাবেলা করেছে তা নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ল্যাবরেটরি থেকে ভাইরাস ছেড়ে দেবার তথ্যটি আমেরিকান সরকার অনুসন্ধান করে দেখছে।

চীনের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ তোলা হয়েছে আমেরিকার পক্ষ থেকে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, যা জানে সে বিষয়ে ‘সত্য কথা বলা উচিত’ বেইজিং কর্তৃপক্ষের।

চীন ও আমেরিকার এই বাকযুদ্ধের মধ্যেই এই ভাইরাস কোথা থেকে এলো, তা নিয়ে ঔৎসুক্য যেমন থেমে নেই, তেমনি উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানের কাজও এগিয়ে চলেছে।

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com