রোহিঙ্গাদের নিয়ে দু’টি নৌকা দীর্ঘ দিন ধরে সাগরে ভাসছে। তারা মালয়েশিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর বাধার মুখে সহায়-সম্বলহীন মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা সাগরে এখন বেওয়ারিশ। এদের মধ্যে একটি অংশ ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। অনেকে রয়েছে মুমূর্ষু অবস্থায়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ওই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছেÑ সাগরে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। বাংলাদেশকেও আহ্বান জানানো হয়েছে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য। আশপাশের কোনো দেশই মানবতার ডাকে সাড়া দেয়নি। রোহিঙ্গারা অন্য সবার মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। অন্যদের মতো তাদেরও রয়েছে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার। আজকের সভ্য বিশ্বের সামনে এ যেন আরেকটি ট্র্যাজেডি। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখছে সাগরে কিছু মানুষ কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
একটি মেডিক্যাল টিমের বরাতে জানা যাচ্ছে, নৌকার যাত্রীদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। কিছু আছে আরো কম বয়সী শিশু। তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৭০ জন প্রাণ হারিয়েছে। বেঁচে থাকা অনেকে সামান্য হাঁটা বা দাঁড়ানোর সামর্থ্যও হারিয়েছে। তারা এখন চামড়ায় মোড়ানো হাড্ডিসার মানুষ। কোনোভাবে প্রাণটা তাদের রয়েছে। অথচ তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ করা আশপাশের দেশগুলোর জন্য কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। সমুদ্র উপকূলের প্রায় প্রত্যেকটি দেশ ধনী। প্রত্যেকটি দেশেই উন্নত গণতন্ত্র চর্চা হয়। তারা মানবাধিকারের অন্যতম রক্ষক। দুর্ভাগ্য হচ্ছেÑ স্রেফ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্ততপক্ষে দুটো প্রভাবশালী মুসলিম দেশও আশপাশে রয়েছে।
মালয়েশিয়া সরকার করোনার অজুহাতে তাদের প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে বলে মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে জানা যাচ্ছে। তারা আরো জানাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য তারা করোনাকে অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করছে। যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে আশ্রয় দেয়া হয়। অন্য দিকে, বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাজ্য সরকারকেই অনুরোধ করেছে, তারা যেন ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর জাহাজ পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের যুক্তি হচ্ছেÑ তারা এ পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে চলেছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বরং ইউরোপের দেশগুলো মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সেখান থেকে জাতিগত উৎখাত অভিযান এখনো বন্ধ হয়নি। তাড়িয়ে দেয়া রোহিঙ্গারা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সব দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও কমে যাচ্ছে, এ অবস্থায় বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় আরো বেশি রোহিঙ্গার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা সুবিচার হতে পারে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমনকি রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতাও তারা অব্যাহত রাখতে পারছে না। মানবাধিকারের রক্ষক শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো। তারা নিপীড়ক রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। তবে এ অবস্থায় একদল মানুষকে আমরা সাগরে মরতে দিতে পারি না। আমাদের অবশ্যই নিজের প্রতি সুবিচার করতে হবে। সাগরে আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের স্বজনরা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করেন। তাদের জন্য অবশ্যই একটি মানবিক দায়িত্ব আমাদের দাঁড়িয়ে যায়। একটি উচ্চ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে এই দুর্দিনে মুমূর্ষু রোহিঙ্গাদের প্রতি আমরা আবারো হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রশংসনীয় হতে পারি।