প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়লেও সে হারে বাড়ছে না রাজস্ব আয়। তাই বাজেটের অর্থায়নে ঋণের প্রাধান্য বাড়ছে। দেশি-বিদেশি ঋণের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধিতে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বিশ্বব্যাংক বলছে, এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা করা। সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক পৃথক পৃথক প্রতিবেদনে এ ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ হ্রাস, ডলার সংকট ও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও কম। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণও কম হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে বিনিয়োগ। ফলে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এদিকে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে থাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে ঋণের জোগানও দিতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায়ও ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ আর্থিক সংকট কাটাতে সরকার বিভিন্ন সেবার মূল্য ও ফি বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপর বাড়ছে চাপ।
উল্লেখ্য, এই মুুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে সাড়ে ১১ লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণের চাপ রয়েছে। এই ঋণ দেশি বা বিদেশি হোক, তা নির্দিষ্ট সময় শেষে সুদসহ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ সভায় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বসন্তকালীন সভায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য এসব ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঋণের মান এখনো ভালো আছে। কিস্তি পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হয়নি। তবে এ দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর। অব্যাহত খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা কমছে না। প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটে। এ ছাড়া কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারায় প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ তিনগুণ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি চাপ সৃষ্টি করছে এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করা বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়ে আসবে।
এসব কারণে বিশ্বব্যাংক মনে করছে, এ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সরকার চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। অবশ্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর এই লক্ষ্য কমিয়ে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে, যা উভয় প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক আর্থিক-মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, মুদ্রা ও আর্থিক নীতি আরো কঠোর করা, ব্যাংক খাত সংস্কারে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে। প্রায় একই রকমের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফও। সে অনুযায়ী ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ কমসূচি শুরু হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক আরও মনে করছে, বাংলাদেশ এখনো লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ছিল ৪৭০ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৭৪০ কোটি ডলার। গত এক বছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি কমলেও রিজার্ভের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় লেনদেনের ভারসাম্যে চ্যালেঞ্জ আরো বাড়ছে।
এদিকে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৩৬ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে এই প্রথমবারের মতো এক বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল। পরিশোধ করা অর্থের মধ্যে আসল ২০১ কোটি ডলার, আর সুদের পরিমাণ প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার।
গত রবিবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বিদায়ী অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ গত অর্থবছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ ও আসল মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে বেড়েছে সুদ বাবদ খরচ। গত অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় আসল পরিশোধ বেড়েছে ২৮ কোটি ডলার বা ১৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আসল পরিশোধ করতে হয়েছিল ১৭৩ কোটি ডলার। অন্যদিকে এক বছরের ব্যবধানে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে সুদ খাতে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে ৪২ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সুদ বাবদ ৯৩ কোটি ডলার খরচ করতে হয়েছিল। বিদায়ী অর্থবছরে প্রথমবারের মতো শুধু সুদ বাবদ খরচও এক বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়ায়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ব্যবস্থাপনায় সংস্কার দরকার। একই সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। তা না হলে বোঝা বাড়বেই।