ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। করোনার কোনো ধরনের উপসর্গ থাক আর না থাক নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া রোগী দেখছেন না হাসপাতালের চিকিত্সকরা। অন্যদিকে পজিটিভ রিপোর্ট ছাড়া করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলো ভর্তি করছে না। ফলে করোনা পরীক্ষা করানোর আগেই হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে মারা যাচ্ছেন রোগীরা। করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বিশাল জটিলতা, বিশৃঙ্খলা। কোথায় গেলে পরীক্ষা হবে অনেকেই জানেন না, আবার দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলা হচ্ছে—আজ হবে না! কেউ পরীক্ষার সুযোগ পেলেও রিপোর্ট পেতে লাগছে পাঁচ-ছয় দিন। ফলে রিপোর্ট আসার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে বিনা চিকিৎসায়।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ক্রীড়া সংগঠক আবদুল মুনায়েম চৌধুরী ইবনে সিনা হাসপাতালে গত শুক্রবার মারা যান। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি। গত মার্চে এই হাসপাতালেই হার্টে রিং লাগানো হয় তার। গত ৪ মে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তির পরই চিকিত্সকরা করোনা পরীক্ষা করতে বলেন। তাকে আইসিইউতে ফেলে রাখা হয়। অনেক চেষ্টার পর ৬ মে তার করোনা পরীক্ষা হয়। কিন্তু রিপোর্ট আসার আগেই ৭ মে তিনি মারা যান। ৮ মে পাওয়া রিপোর্টে দেখা যায় তিনি করোনা নেগেটিভ ছিলেন।
এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর। প্রথম দিকে পিপিই, মাস্ক, ফেস শিল্ড না থাকার অভিযোগ এনে চিকিৎসা থেকে বিরত থাকেন অনেক চিকিৎসক। কিন্তু এখন এসবের অভাব দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কেন রোগীরা চিকিৎসা পাবেন না ? সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই হাত ভরে চিকিৎসকদের দিচ্ছেন, ঝুঁকি ভাতা ঘোষণা হয়েছে। বিশাল বাজেট ঘোষণা হয়েছে চিকিৎসার জন্য। তাহলে বিনা চিকিৎসায় কেন মৃত্যু হবে রোগীর?
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, আগে ঢাকা মেডিক্যাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের বিশাল লাইন ছিল। এখন সেই রোগীরা কোথায়? তখন তো দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো একটি সিট পেতে। রাতারাতি কি সেই সব রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন? তারা তো আছেই। এখন কথা হলো, সব রোগীকে চিকিৎসা করতে হবে। পরীক্ষা করা ডাক্তারের দায়িত্ব, রোগীর না। কোনো চিকিৎসক যদি মনে করেন, রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাস থাকতে পারে, তাহলে চিকিৎসকের দায়িত্ব তার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। কোথায় ফোন করবেন, কাকে ডাকবেন, কীভাবে পরীক্ষা করাবেন সেটা চিকিৎসককেই ঠিক করতে হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাসের সভাপতি ও যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলমের বোন ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন। তার স্বজনরা জানিয়েছেন, কোনো চিকিৎসক তার বোনকে দেখতে যান না। নার্সরা মাঝে মধ্যে যান। সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন করোনা উপসর্গ নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কোনো চিকিত্সকই তাকে দেখেননি। পরে বিকাল ৫টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপে তার করোনা পরীক্ষা হয় এবং রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু ঢাকা মেডিক্যালেই নয়, রোগীদের চিকিৎসার এমন অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালেও।
আগে ঢাকা মেডিক্যালে গড়ে ২০ থেকে ৩০ জন রোগী মারা যেত। আর সারাদেশে গড়ে ৫ শতাধিক রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যেত। তাহলে এখন তারা কি মারা যাচ্ছেন না? সেইসব রোগী তো মরছে। তাদের হিসেব কে দেবে?
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ ইত্তেফাককে বলেন, এখন ধরে নিতে হবে সব রোগীই করোনা রোগী। সব হাসপাতালেই সাধারণ রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি করোনার চিকিৎসাও থাকতে হবে। কোনো রোগী ফেরত দেওয়া যাবে না। যারা চিকিৎসা বন্ধ রেখেছে তাদের হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।
অনেক এলাকায় এলাকাবাসীও করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করছেন। অনেকের বাড়িতে তালা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ বাসায় ডেকে টেস্ট করাতে চাইলে কয়েক দিন লেগে যাচ্ছে, তবুও টেকনিশিয়ানরা যাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নানা আশ্বাস আর প্রস্তুতির গল্প শোনানো হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তারা শুধু মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা গুনে যাচ্ছে।
বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিটি এলাকায় পরীক্ষার সুযোগ দিতে হবে। তিনটি বেসরকারি হাসপাতালকে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি। তারা শুধু তাদের নিজেদের রোগীদের পরীক্ষা করবে। ঐ সব হাসপাতালে তো ধনীরা যান। সাধারণ মানুষ যেসব ক্লিনিকে যায় সেখানেও পরীক্ষার সুযোগ থাকতে হবে।