নজরুল ইসলাম মজুমদার নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান। দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত তিনি এক্সিম ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান। ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস’রও (বিএবি) সভাপতি। এর চেয়েও তার বড় পরিচয় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময় চাঁদা তুলে সব ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানদের নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে চেক তুলে দিতেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর পাশেই তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন। এ ছবি পরদিন বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশ হতো। অনেক ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানরা শেখ হাসিনার হাতে চেক তুলে দেয়ার ছবিটি ক্যামেরা বন্দী করে ব্যাংকে ও বাসায় সবার নজর কাড়ে এমন জায়গায় টাঙ্গিয়ে রেখে নিজেদের ধন্য মনে করতেন। শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দেয়ার কারণে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন আলোচিত এ ব্যবসায়ী। অভিযোগ রয়েছে কিস্তি পরিশোধ ছাড়াই এসব ঋণ নবায়ন হয়ে যেত। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী দুর্বার ছাত্র আন্দোলনের মুখে দীর্ঘ ১৫ বছরের হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক দিন আগেই নজরুল ইসলাম মজুমদার দেশের বাইরে সপরিবারে চলে গেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার ওপর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ আগলে রাখা নজরুল ইসলাম মজুমদারের এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ গতকাল ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি পাঁচ সদস্যের নতুন পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন উদ্যোক্তা পরিচালক ও দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালক রয়েছে। নতুন পরিচালকরা হলেন শেয়ারধারী পরিচালক মো: নুরুল আমিন, নজরুল ইসলাম স্বপন ও অঞ্জন কুমার সাহা। আর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এস এম রেজাউল করিম ও সনদধারী হিসাববিদ খন্দকার মামুনকে। নতুন নিয়োগ পাওয়া পাঁচ পরিচালকের মধ্য থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবেন।
গতকাল ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশে বলা হয়েছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিতের জন্য জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ বা এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক্সিম ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদে তার অনুগত ছাড়া কাউকে রাখা হয়নি। ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিতে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকেই ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাদ দেয়া হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ধরে রেখেছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তিন বছর করে দুই মেয়াদের বেশি ব্যাংক পরিচালক থাকতে পারবেন না। একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক হতে পারবেতন। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে তা তিন মেয়াদে ৯ বছর করা হয়। জানা গেছে, নজরুল ইসলাম মজুমদার ২০০৬ সালের শেষের দিকে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক হন। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছরেও তার চেয়ারম্যান পদ থেকে কেউ সরাতে পারেনি। এ সময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার ওপর উচ্চ আদালত থেকে স্থাগিতাদেশ নিয়ে আজীবন এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক পদটি ধরে রাখেন।
তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তার পরি বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারতেন না। এমনকি কোনো সংবাদমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ পরিবেশন করা হলে মামলার জালে আটকিয়ে হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে উদ্যোক্তাদের সুবিধা বাড়ানো ও নীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রেখে আসছিলেন তিনি। সর্বশেষ বিএবির পক্ষ থেকে ‘শেখ হাসিনা আন্তব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজন করে তিনি সমালোচিত হন। সরকার পরিবর্তনের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে তার স্ত্রী নাছরিন ইসলাম ও তাদের পুত্র-কন্যার ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। সবশেষে গতকাল এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে তার চেয়ারম্যান পদটিও হারালেন।
সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তাদের ছাড় দেয়া হবে না। টাকা উদ্ধারে আইনগত যত পন্থা আছে, সবই অনুসরণ করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হবে। নতুন গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুর যোগ দেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাতটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবি ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি ব্যাংকই এ খাতের আলোচিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।