বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন? গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন ১৫ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা শেখ হাসিনা। গতকাল তার দেশত্যাগের দুই মাস পার হয়েছে। এরই মধ্যে তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট বাতিল করে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। হাসিনা এখন ভারতে কোন পরিচয়ে আছেন তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ভারত সরকারও সে দেশে তার অবস্থান নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। খবর বেরিয়েছে হাসিনা এখন অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন।
এ দিকে ৮০ বছরের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া হাসিনার রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে আলোচনা চলছে। দলের সভাপতির দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রায় সর্বস্তরের নেতারাই দুর্র্নীতি আর হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক একনিষ্ঠ কর্মী মনে করেন তাদের নেত্রী আবার বাংলাদেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন।
কিন্তু রাজনীতিতে হাসিনার ফেরা কি আদৌ সম্ভব? হাজারো শহীদ আর অসংখ্য আহত মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের সফল আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? এ নিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন। তাদের প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির যে নেতৃত্বশূন্যতা, সেটিই এক সময় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসার পথ এবং রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেবে।
নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক এবং বাংলাদেশের নাগরিক মোবাশ্বের হাসান এ প্রসঙ্গে টাইম সাময়িকীকে বলেন, ‘বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারের বৈধতা রয়েছে, জনসমর্থনও রয়েছে; কিন্তু এই সরকার নির্বাচিত কোনো সরকার নয়। নির্বাচিত সরকারের মতো তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। শেখ হাসিনা যদি চান, তাহলে এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে এক সময় দেশে ফিরে আসতে পারবেন। এটা কেবলই সময়ের অপেক্ষা।’
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক সংস্থা উইলসন সেন্টারের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানও এমনটা মনে করেন। টাইম সাময়িকীকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন শুধু সম্ভবই নয়, খুবই সম্ভব। কারণ পরিবারতন্ত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় এটি চলে আসছে। মাত্র বাংলাদেশে সহসাই এ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এমনটা প্রত্যাশা করা যায় না। তার পরও হয়তো বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যেতো, যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হতো। কিন্তু দেশটির যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে এটি একেবারেই সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ এখনও বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থা সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান টাইম ম্যাগাজিনকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং তার চলে যাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকতে পারে তা একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পনা। অবশ্য এই সরকার যদি সার্বিকভাবে ভেঙে পড়ে, তাহলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।’ এবং এই সরকারের ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বেশ ভালোভাবেই রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক শহীদুল হক। টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। পনের বছর কিন্তু অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের পুরো আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনকে নিজের মতো করে সাজিয়েছে দলটি। বর্তমান সরকার কয়েকজন চিহ্নিত আমলা ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো এই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া প্রশাসন ঢেলে সাজাতে গেলে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার পারত পক্ষে কোনোভাবেই এ ঝুঁকি নিতে চাইবে না। আর এই প্রশাসন এবং আমলাতন্ত্রই আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে ফের বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনবে।’
তবে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতন মহল বিষয়টা বুঝতে পেরে নড়ে চড়ে বসার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক মহল দাবি তুলেছে হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীদের প্রশাসন থেকে দ্রুত সরিয়ে বঞ্চিত ও সৎ লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানো হোক। সরকারও প্রশাসনে সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তার ফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন যে, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। পরে অবশ্য তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি গুঞ্জন উঠেছে যে, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তিনি (জয়) দলের হাল ধরবেন। তিনি সত্যিই এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে টাইম ম্যাগাজিনকে জয় বলেন, ‘আমার কখনওই রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না; কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে ভবিষ্যতে কী হয় তা কে বলতে পারে? আমি এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি।’
তবে জয় যদি রাজনীতিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে এই মুহূর্তে সেটি সঠিক সিদ্ধান্ত হবে কী না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ মীনাক্ষী গাঙ্গুলী।
টাইম সাময়িকীকে মীনাক্ষী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, দলটির রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার পুরোটা জুড়েই রয়েছেন শেখ হাসিনা। তারা বঙ্গবন্ধু কন্যার বাইরে অন্য কাউকে দলীয় প্রধান বা সরকার প্রধানের পদে দেখতে প্রস্তুত নয়। আওয়ামী লীগ যদি তার ভুলগুলো স্বীকার করে, দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধি করে এবং নিজেকে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে, কেবল তাহলেই বর্তমান সঙ্কট থেকে দলটির উত্তরণ সম্ভব।’