জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত বাজেটের হিসাব মেলাতে বিশেষজ্ঞরা হিমশিম খাচ্ছেন। করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও মন্দার ধাক্কায় রয়েছে। চলতি বাজেটে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সরকার গতানুগতিক ধারায় একটি উচ্চাভিলাষী বাজেটই উপস্থাপন করেছে। বাজেটের আকার এ বছর আরও বেড়েছে। প্রবৃদ্ধিও দেখানো হচ্ছে ৮.২ শতাংশ। অথচ বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১.২ শতাংশ। আর দেশীয় অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ ধারণা করছেন তারাও ৪-৫ শতাংশের বেশি ভাবছেন না। এদিকে এনবিআরের চেয়ারম্যান আগেই একটি চিঠির মাধ্যমে অর্থ বিভাগের সচিবকে জানিয়েছিলেন, আগামী বছর তার কর্মীরা সর্বোচ্চ আড়াই লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হতে পারে। ফলে দেখা যাচ্ছে পূর্বঘোষিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা বা তার বেশি হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩ লাখ কোটি টাকাই ঘাটতি হবে। এই ঘাটতি পূরণে সরকারের উৎস হতে পারে তিনটিÑ বৈদেশিক সাহায্য, ব্যাংকঋণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা মুদ্রণ। শেষের দুটির কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়া অনিবার্য। ফলে প্রাক্কলিত ৫.৪ শতাংশের ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। এর ফলে ইতোমধ্যেই চাপে পড়া মধ্যবিত্ত, নিম্ন ও দরিদ্র মানুষ চরম সংকটের মধ্যে পড়বে।
বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে সবাই প্রত্যাশা করেছিল গতানুগতিক পথ ছেড়ে সরকার বাস্তবের চাহিদা অনুযায়ী বিচক্ষণতার সঙ্গে একটি ব্যতিক্রমী বাজেট উপস্থাপন করবে। সম্ভবত সে প্রত্যাশা পূরণ হলো না। এই সংকটকালে বাজেটে ৪টি মন্ত্রণালয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা দরকার ছিলÑ স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা ও শিক্ষা। এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও সুনির্দিষ্ট কর্ম বাস্তবায়ন পরিকল্পনার অভাবে বাজেটকে দিকনির্দেশনাহীনই বলা যাবে। বাস্তবে আমরা দেখছি, করোনা মহামারী ঠেকানোর জন্য নানা উদ্যোগ ও অর্থায়ন হলেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক কাজ হচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অর্থ সংযোজনের দিক থেকে কৃষি পিছিয়ে থাকলেও আদতে এর মেরুদ-ই হচ্ছে কৃষি। বিশেষত এই দুঃসময়ে মানুষের প্রধান প্রয়োজন খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি হচ্ছে একমাত্র পথ। এবং এই খাতটি গত কয়েক বছরের মতো এখনো সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কৃষির আওতাভুক্ত ডেইরি, পোলট্রিসহ সব খাতকে বিপণন সুরক্ষা দেওয়া জরুরি। নয়তো উদ্যোক্তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং উৎপাদিত মূল্যবান ভোগ্যপণ্য নষ্ট হবে। এই সময়ে এটি একেবারেই কাম্য নয়। করোনার মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম দুর্বলতা উদ্ঘাটিত হয়েছে। ফলে করোনা চিকিৎসার জন্য অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী ভিত্তি দেওয়ার জন্য বাজেটে বরাদ্দ ও দিকনির্দেশনা ছিল জরুরি। আবার এই কারোনাকালে দেখা যাচ্ছে সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি শিক্ষায় প্রযুক্তিনির্ভর নতুনতর পদ্ধতির প্রয়োগ অপরিহার্য। সেই অনুযায়ী নিচে থেকে ওপরে পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা বাজেটে দৃশ্যমান হওয়া উচিত ছিল। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, যখন দেশে ৯৫ শতাংশ মানুষের উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো এবং তাকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার দিকনির্দেশনাও বাজেটে কাম্য ছিল। আমরা আশা করব বাজেট অনুমোদনের আগে এসব বিষয় বিবেচনা করে সরকার প্রয়োজনীয় সংশোধনের উদ্যোগ নেবে। এবারের বাজেট হওয়া উচিত দুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকার বাজেট। টিকে থাকলেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার হারানো গতি আমরা আবার ফিরে পাব।