কবির, সাহেব আলী, সাবিনা- এরা রাজধানীর দক্ষিণ কমলাপুরে নিউ নেক্সট গার্মেন্টসের শ্রমিক। করোনার শুরুতে এই কারখানার অনেকেই গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আবার ঈদের ছুটিতেও এদের অনেকে গ্রামের বাড়িতে যান। দুই দফায় তাদেরকে বাড়ি থেকে আনা হয়। না এলে চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়া হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। এখন তাদেরকে কিছু না বলেই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে মালিক। জুন মাসের আজ ২১ তারিখ। অথচ মালিক তাদেরকে মে মাসের বেতনই পরিশোধ করেননি। এভাবে প্রতিদিনই বেকার হচ্ছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে। ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে কারখানা। আবার অনেক কারখানায় নোটিশ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। করোনার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে বলে শ্রমিক নেতারা জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি মাসেই তৈরী পোশাকসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এরমধ্যে সর্বাধিক শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএইএ) সদস্যভুক্ত ৮৬টি কারখানায়। এখানে ১৬ হাজার ৮৫৩ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্যভুক্ত ১৬টি কারখানায় ছাঁটাই হয়েছে দুই হাজার ২৯৮ শ্রমিক। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্যভুক্ত চারটি কারখানায় ২৫৮ ও বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আটটি কারখানায় ৫৬ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এসব সংস্থার বাইরে বিভিন্ন ধরনের ১৫টি কারখানায় ছাঁটাই করা হয়েছে আরো এক হাজার ৮৬৬ জন। বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি মাসের শুরুতে গত ৪ জুন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক শ্রমিকদের জন্য করোনা ল্যাব উদ্বোধনের সময় বলেন, ‘জুনের শুরু থেকেই কারখানায় পোশাক শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে।’ বিষয়টি ‘অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শতকরা ৫৫ ভাগ ক্যাপাসিটিতে ফ্যাক্টরি চললে, মালিকদের পক্ষে শ্রমিক ছাঁটাই ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। পরিস্থিতি যদি একটুও পরিবর্তন হয় তাহলে এই একই শ্রমিকেরা একই কারখানায় যোগদানে অগ্রাধিকার পাবেন।’ রুবানা হক শ্রমিকদের ছাঁটাই করার সময় মালিকদের অবশ্যই শ্রম আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বলেন।
শিল্প পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বাধিক শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে গাজীপুর এলাকায়। সেখানে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোতে আট হাজার ৫৬২ জন শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এরপরই রয়েছে আশুলিয়া এলাকা। সেখানে বিজিএমইএর ৪৯টি কারখানার মধ্যে পাঁচটি কারখানায় ছয় হাজার ৮৫৭ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এসব শ্রমিকের মধ্যে পাঁচ হাজার ৬৩৪ জনেরই চাকরির বয়স এক বছরের কম। নারায়ণগঞ্জে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১১ কারখানায় ৬১৬ জন ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৭০৫ জন শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত ১১টি কারখানার দুই হাজার ৮৫ জন শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। আশুলিয়া এলাকায় বিকেএমইএর কারখানাগুলোতে ছাঁটাই করা হয়েছে ২১৩ জন শ্রমিক। শিল্প পুলিশের হিসাবে চার সংগঠন ও সংস্থার বাইরে ১৫টি শিল্পকারখানায় ১০ হাজার ৬৪৫ জন শ্রমিক কর্মরত। তাদের মধ্যে এক হাজার ৮৬৬ জন শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।
গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোশরেফা মিশু নয়া দিগন্তকে বলেন, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো আইন মানা হচ্ছে না। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া দূরে থাক তাদের বকেয়া বেতনই পরিশোধ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রতিদিনই শ্রমিক ছাঁটাই চলছে।
জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো আইন মানা হচ্ছে না। করোনার মধ্যে অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এরমধ্যে কাউকে টাকা দেয়া হয়েছে কাউকে কোনোই টাকা দেয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণ তো দেয়াই হয়নি। বাহার বলেন, ডিজিটাল সিস্টেমে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে চাকরি নেই।