বাংলাদেশের আদালত কয়েক বছর ধরে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের প্রতিকার পাওয়ার চেয়ে এর রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে চলছে এই বিতর্ক। দ্রুত প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজন মামলার গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচার কাজ চালানো। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে মানুষটি সমাজে সবচেয়ে কম ক্ষমতা রাখে; বিচার পাওয়ার সুযোগও তার কম বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য দিকে যার প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি বিচারের ক্ষেত্রে সুবিধা নিচ্ছে। অনেকে তাই শিকার হচ্ছে অন্যায়ের। একটি দেশের বিচারব্যবস্থা মানুষকে যদি প্রতিকার দিতে ব্যর্থ হয়; তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে খুব একটা কার্যকর রাষ্ট্র বলা যায় না। সহযোগী একটি দৈনিক অপ্রয়োজনীয় মামলা নিয়ে আদালতের ব্যস্ততার ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে।
দেশে ১৬ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন যে পরিমাণে বিরোধ বিসংবাদ হচ্ছে; সেটা নিয়মিত মিটিয়ে দেয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের এ বিচার অবকাঠমোর নেই। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আদালতের সামনে মেরিটহীন বিবাদ সামনে আনছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, হিংসা চরিতার্থ করতে প্রতিপক্ষের জীবন দুর্বিষহ করা, সামাজিক সুনাম নষ্ট ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে এসব মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় মামলা আরো জন্ম দিচ্ছে একাধিক মামলার। সারা দেশে এমন মামলাবাজের অভাব নেই। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের হয় এক লাখ ২৮ হাজার ১১৭টি। পুলিশের তদন্তে পরে দেখা গেছে, এর ৯০ শতাংশ মিথ্যা। জমিজমা, খুনখারাবিতেও একই প্রবণতা রয়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজের সন্তানকে হত্যার একাধিক ঘটনা আমরা দেখেছি।
সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এমন মামলা করতে দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতো প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের মামলা করছে। পাটকল শ্রমিক জাহালমের বিরুদ্ধে দুদক ৩৬টি চার্জশিট দায়ের করে। উচ্চ আদালতে ওগুলো সব ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ওয়ান-ইলেভেনের সময় আড়াইশ’র মতো মামলা দায়ের করে। উচ্চ আদালতে এগুলো ‘মিথ্যা’ ও ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলে বাতিল হয়ে যায়। অন্য দু’টি প্রতিষ্ঠানকেও একই ধরনের ভিত্তিহীন মামলার দায়েরের হিড়িক দেখা যায়। সরকার এগুলো অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। সরকার কোনো একটা ব্যাপারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে আদালত সেটি বিবেচনায় না নিয়ে পারেন না। এভাবে আদালতকে অনেক সময়ই গুরুত্বহীন মামলায় ব্যস্ত করে রাখা হয়। ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থী বিচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের আদালতে এখন ৩৭ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন।
বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছে। এ স্বীকৃতি এখন বিচার পাওয়ার অধিকারকে সঙ্কুচিত করছে। সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারায় এমনটি হচ্ছে। একটি মামলা দায়ের করার আগে সেটা আদৌ আদালতে ওঠার এখতিয়ার রাখে কি না তার পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে না। যেসব বিরোধের মীমংসা সামাজিকভাবে হতে পারে সেগুলো আদালতে উঠে আসছে। পুলিশ যখন একটি মামলা অগ্রসর করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে হয় না। সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাবের বিবেচনায় সেসব মামলা দেখা হয়। একইভাবে আদালতে মামলা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এর মেরিটের চেয়ে মামলাকারীর চেহারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সরকারও একই কাজ করে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিচারের পরিবর্তে আদালতপাড়ায় বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে করা মামলার তোড়জোড় দেখা যায়।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের দেশে ভুতুড়ে মামলার সংখ্যাও কম নয়। মামলার যিনি প্রতিপক্ষ তিনি জানতেই পারেন না তার প্রতিপক্ষ কে। তার আগেই গ্রেফতার হতে হয়। আদালতে অনেকে তার সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। কিন্তু যেসব অপরাধের বিচার হওয়া দরকার, যেসব অপরাধীর শাস্তি পাওয়া দরকার; তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আদালতকে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার জায়গা করে দিতে হলে অপ্রয়োজনীয় মামলার উৎপাত কমাতে হবে।