বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার সংসদে শেষ দিনে তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পেছনে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা, পাকিস্তানি শাসকদের হাতে দীর্ঘ সময়ের নির্যাতনের কথা। বঙ্গবন্ধু এমন একজন বাঙালি, যাঁর কথা বাংলাদেশের যেকোনো বিষয় এলেই এসে পড়ে এবং বাঙালিকে দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হয়। বিশেষ করে, আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের নেতা এবং আমাদের প্রজন্ম হচ্ছে তাঁর জাতির পিতা হয়ে উঠার সাক্ষী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু একটি বিষয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন আর তা ছিল দুর্নীতি। তিনি তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে জাতীয় সংসদের ভেতরে বা বাইরে যত জনসভায় বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রায় সব কটিই ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ তিনি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে দলের ৪২ জন নেতা ও সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে দেশের শাসনভার এবং তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দেশটিকে সঠিক পথে রাখার জন্য, পিতার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর দলে এমন কিছু দুর্বৃত্তের অনুপ্রবেশ ঘটেছে যে তিনি তাদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না এবং তাঁর কষ্টার্জিত সব অর্জন এসব দুর্বৃত্ত নস্যাৎ করে দিতে দিনরাত নানা ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কর্মের কারণে দেশের বাইরেও বাংলাদেশের সুনামের ক্ষতি হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট ২৫০ জনেরও বেশি যাত্রী নিয়ে ইতালি গেল এবং দেখা গেল তাঁদের অনেকের কভিড-১৯ পজিটিভ। সেই বিমানকে শুধু ফেরতই পাঠায়নি, আগামী তিন মাসের জন্য বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে বিমানের সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। বুধবার কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ১২৫ জন বাংলাদেশি যাত্রী নিয়ে রোম অবতরণ করলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ওই ফ্লাইটের সব যাত্রীকে রোম থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। যাঁরা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাঁরা কভিড নেগেটিভ সনদ নিয়ে বিমানে চড়েছিলেন এবং চিন্তা করেছিলেন ঢাকা বিমানবন্দরে যেমন ফাঁকি দিয়ে অথবা ঘুষ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া যায়, তেমনটা বোধ হয় রোম বিমানবন্দরেও করা যাবে। তাঁরা বুঝতে পারেননি ঢাকায় এসে যেমন করে হৈচৈ করতে পারেন বা যে কুিসত ভাষায় নিজের জন্মস্থান বাংলাদেশকে গালি দিতে পারেন, তা তাঁদের পক্ষে অন্য দেশে করা সম্ভব নয়। পরে জানা গেছে, যে দুর্বৃত্ত গত মার্চ মাসে এই অপকর্মটি করেছিলেন তিনি দেশে সরকারি দলের এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন। ঠিক একই কাণ্ড ঘটেছে চীনের গুয়াংজু বিমানবন্দরে। ফলে চীন বাংলাদেশ থেকে সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। জাপানও একই কারণে বাংলাদেশিদের সে দেশে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। রোমের ঘটনা সেই দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিক ও অন্যান্য গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে নাকি সাড়ে তিন হাজার টাকা দিলে করোনা নেগেটিভ সনদ পাওয়া যায়। এই যে তাঁরা কভিড-১৯ পজিটিভ নিয়ে দেশ ছাড়লেন, তাঁরা নেগেটিভ সনদ কোত্থেকে জোগাড় করলেন? উত্তর খুব সহজ। নিশ্চয় উত্তরার বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ একজন বড়মাপের বাটপার সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতাল বা অনুরূপ অন্য কোনো হাসপাতাল থেকে।
গত কয়েক দিন গণমাধ্যমে সাহেদ করিমের নাম বেশ ফলাও করে আলোচিত হচ্ছে একজন বড়মাপের বাটপার হিসেবে, যিনি শুধু আওয়ামী লীগের অনেক নেতার ঘনিষ্ঠই ছিলেন না, তিনি একজন জাত প্রতারক ছিলেন। এসএসসি পাস এই বাটপার নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন, কখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে পরিচয় দিতেন আবার কখনো কখনো বলতেন তিনি গণভবনে অফিস করেন। তবে বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেনাকুঞ্জে তাঁর যাতায়াত ছিল অবারিত। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নেই, যাঁদের সঙ্গে সাহেদের ছবি নেই। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের রাতের টক শোতে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যাট চালাতেন, নীতিবাক্য শোনাতেন নিয়মিত। জানা গেছে, এই কাজগুলো তিনি সংশ্লিষ্ট প্রযোজককে টাকা দিয়ে করতেন। এটি আমার কাছে একটি অবাক করার মতো খবর। টাকা দিয়ে টক শোতে অংশগ্রহণ! সাহেদ একসময় এমএলএম ব্যবসার নামে মানুষকে প্রতারণা করে জেলে গেছেন, তাঁর নামে এখনো ৩২টি প্রতারণার মামলা আছে। চলতেন চারজন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে। ঢাকার বাইরে গেলে আশ্চর্যজনকভাবে পেতেন পুলিশ প্রটোকল।
মিরপুর ও উত্তরায় অবস্থিত সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৪ সালে, তার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে তাঁর হাসপাতাল চালু ছিল এবং সম্প্রতি এই ভুয়া হাসপাতাল কভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। র্যাবের হাতে এই হাসপাতালের ভুয়া কভিড বাণিজ্য ধরা পড়ার পর প্রশাসন হাসপাতাল দুটি সিলগালা করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুর্বৃত্ত মিঠু। তাঁর প্রতারণা শুরু হয়েছিল বিএনপি আমলে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের কোমর ভেঙে দেওয়ার পেছনে তাঁর অবদান সর্বাধিক। সব সরকারের সময় মিঠুর উত্থান ত্বরান্বিত হয়েছে। কেউ তাঁকে নির্বৃত্ত করার চেষ্টা করেনি। শুধু মিঠুর সুযোগের সীমা বেড়েছে। এসব দুর্বৃত্তের শক্তি হচ্ছে দলের ভেতরের কিছু নেতা এবং তাঁদের জোরেই সাহেদরা এত সব অপকর্ম করার সাহস পান। এর ফলে সরকার ও দল বদনামের ভাগী হয়। সাহেদরা হচ্ছেন রাষ্ট্রের ভেতর অনুপ্রবেশকারী চোর, যাঁদের একমাত্র কাজ হচ্ছে নানা অপকর্মের মাধ্যমে সরকার তথা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বেকায়দায় ফেলা। বর্তমানে এমন চোরের সংখ্যা দলে কিলবিল করছে। বলা বাহুল্য সাহেদের মতো যত বড়মাপের দুর্বৃত্ত বর্তমানে সমাজে বিচরণ করছেন তাঁদের বেশির ভাগেরই সরকারের ভেতর শক্তিশালী খুঁটি আছে। আরো দু-একজনের নাম বললে অনেকে বেকায়দায় পড়বেন।
শামীমা নূর পাপিয়ার কথা পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, যিনি পাঁচতারা হোটেলে প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট ভাড়া করে হেরেমের রমরমা ব্যবসা চালু করেছিলেন। ছিলেন নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কিছু দলীয় নেতাও ছিলেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শেষতক তিনি ধরা পড়লেন র্যাবের হাতে। বদনামটা হলো আওয়ামী লীগের। এঁদের দলের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার পেছনে নিশ্চয় কোনো বড় নেতার সহায়তা আছে।
লক্ষ্মীপুর থেকে গত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন শহিদ ইসলাম পাপুল। সেই আসনে ১৪ দল থেকে জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থী ছিলেন। শেষ মুহূর্তে এক রহস্যজনক কারণে পাপুলের পক্ষে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। ঘটনা সেখানে থেমে থাকেনি। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা সচরাচর যা করার কথা চিন্তা করেন না, তিনি সেই কাজটি করলেন। নিজের স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য করে আনলেন। এটি একটি বিরল ঘটনা। একজন সাংবাদিক তাঁর এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, এই কর্মকাণ্ডে পাপুল ৫০ কোটি টাকা খরচ করেছেন। কারা পেলেন এই বিপুল পরিমাণ অর্থ? পাপুল যেমন রাষ্ট্রের ভেতর একজন দুর্বৃত্ত, ঠিক যাঁদের হাতে এই অবৈধ অর্থ গেছে তাঁরাও একই কাতারের দুর্বৃত্ত। মানবপাচার, মানি লন্ডারিং ও আরো একাধিক অপরাধের দায়ে পাপুল কুয়েত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে সেই দেশের কারাগারে।
রাষ্ট্রের মধ্যে চোর শুধু সাহেদ, পাপিয়া বা পাপুলে সীমাবদ্ধ নয়। আছে জি কে শামীম ও অন্যরা। জেকেজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তাঁর স্বামী আরিফ। তাঁরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা ছাড়া ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনা টেস্টেও ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। র্যাবের অভিযানে তাঁদের কুকীর্তি ধরা পড়ে।
গত কয়েক বছরে সরকার আর বঙ্গবন্ধুর গড়া দল আওয়ামী লীগে আরো কত চোর যে ঢুকেছে তার হিসাব করা মুশকিল। এসব অনুপ্রবেশকারীর কারণে আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া, ত্যাগী নেতাকর্মীরা একেবারেই কোণঠাসা। তাদের কর্মকাণ্ডে শুধু যে সরকার বিপাকে পড়ছে তা-ই নয়, খোদ সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেও একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। কার জন্য তিনি এত পরিশ্রম করেন? নিশ্চয় কিছু দুর্বৃত্তের জন্য নয়। সরকার ও দলের প্রতিটি স্তরে এখন চোর আর দুর্বৃত্তরা বেশ নিরাপদে অবস্থান করছে। সময় হয়েছে সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি শুদ্ধি অভিযান চালানোর। এখনো দলের অনেক নিবেদিত নেতাকর্মী আছেন, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে দল ও বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সমর্থন করেন; কিন্তু তাঁর কাছে ভিড়তে পারেন না। তাঁরাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন দিয়েছিলেন।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক