বাংলা প্রবাদ রয়েছে ‘যা রটে তা কিছু বটে’। সরকারি দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ‘গুজব’ ডালপালা মেলেছে, যা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে লুকায়িত তথ্য হিসেবে। কেউ কেউ আবার এর মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের সম্ভাবনাও খুঁজছেন। তবে গুজব কিংবা বাস্তবতা যেটিই হোক, মাসখানেক ধরে রাজনীতিতে এক ধরনের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের ‘সরব নেতারা’ কিছুটা নীরব হয়ে গেছেন। কে কখন শুদ্ধি অভিযানে ধরা পড়েন, এমন একটি অবস্থা তাদের মধ্যে বিরাজ করছে। বিরোধী দলগুলো চলমান পরিস্থিতিকে ‘রাজনৈতিক সঙ্কট’ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছেন। সঙ্ঘবদ্ধ কোনো কর্মসূচি তাদের না থাকলেও অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের পদত্যাগ দাবি করছেন তারা। ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারেরও একটি রূপরেখা দেয়া হয়েছে। রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের ধারণা- ‘বিতর্কিত’ একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলগুলোর শক্ত উপস্থিতির অভাবে প্রতিবাদের ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্ম গড়ে উঠছে, যা সরকারকে কিছুটা হলেও বেকায়দায় ফেলেছে।
গত মাসের মাঝামাঝি থেকে সরকার নিজ দলের অসৎ নেতাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছে। যে অভিযান রাজনীতিতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রতাপশালী বহু নেতা ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। প্রশ্নবিদ্ধ নেতাদের দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। একইসাথে বহু নেতা-এমপির ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন।
হঠাৎ করে সরকার কেন এই অভিযান শুরু করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গত মাসে নিউ ইয়র্কে বলেছেন, আরেকটি এক-এগারো রুখতেই এই অভিযান। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। তথাকথিত রাজনৈতিক দুর্নীতি দমনই ছিল ওই সরকারের লক্ষ্য। যার অংশ হিসেবে তারা সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরেকটি এক-এগারো রুখতেই এই অভিযান চলছে বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অনমনীয় মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে।
তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই অভিযান কেবল দুর্নীতিবিরোধী ড্রাইভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। তারা এর অন্তরালের ঘটনা খুঁজছেন। নানা আলোচনায় লিপ্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, ক্ষমতার পথ আরো মসৃণ করতে এই অভিযান চলছে। কেউবা বলছেন, এর উদ্দেশ্য ভিন্ন, যা একটি পর্যায়ে ভিন্ন রূপ নিতে পারে। তবে কারণ যাই-ই হোক, আপাতদৃষ্টিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তেমন কোনো বিচলিত অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। বরং ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০-২১ সালকে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তা বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালনের প্রস্তুতি চলছে। তার আগে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় কাউন্সিল করে আওয়ামী লীগকে নতুন নেতৃত্বে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে, এমন শঙ্কা থাকলেও বাস্তবে তেমন কিছুই হয়নি। নির্বাচনের পর ইতোমধ্যে কেটে গেছে আট মাস। তবে রাজনীতির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সামাজিক নানা অস্থিরতা লেগেই আছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির নানা চিত্র সামনে উঠে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজের ক্ষুব্ধ অবস্থান প্রশমিত হলেও এমন ঘটনা আরো জন্ম নিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার প্রতিবাদে ভোলায় পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ায় আলেমসমাজ তথা সর্বস্তরের মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তবে এ ঘটনাকে কেউ কেউ পূর্ব পরিকল্পিতও বলছেন।
এসব নানা ঘটনায় বিরোধী দলগুলোও ধীরে ধীরে সোচ্চার হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর অন্দরমহলে ‘সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না’ এমন কথাও আলোচিত হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৮ দিন বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণে সরকারের পদত্যাগ দাবি ও নতুন নির্বাচন চেয়েছেন। গণফোরাম সভাপতি ড. কমাল হোসেনও সাম্প্রতিক সময়ে কড়া কথা বলা শুরু করেছেন। তিনি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘একাদশ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি।’ তার এই বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। মেননের এই বক্তব্য মুখ ফুটে বেরিয়ে গেছে, কেবল এমনটা অনেকেই ভাবছেন না।
তবে সরকারি দল সামাজিক নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কিংবা বিরোধীদের এমন উচ্চবাচ্য খুব একটা আমলে নিচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না।