কোনো দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য দুর্যোগ কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়, হতে পারে তা মানবসৃষ্ট অথবা প্রাকৃতিক কারণে। ইতিহাসে দেখা যায়, সেই প্রাচীনকাল থেকে দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগ হয়েছে; হয়েছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেই সব দুর্যোগ থেকে মানুষ কিভাবে বা কত সহজে নিস্তার পেয়েছে তা নির্ভর করেছে সেই দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের ওপর। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪০ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে পর পর সাত বছর অনাবৃষ্টির কারণে মধ্যাঞ্চলে ভয়াবহ খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রথম দিকে হারভার্ট হুভার, পরে ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট। তাঁরা এই সংকট মোকাবেলায় তেমন একটা ভূমিকা পালন করতে পারেননি, বিশেষ করে হুভার। দুর্ভিক্ষে মানুষ সীমাহীন দুর্গতিতে পড়ে এবং সাত হাজারের ওপর মানুষ মারা যায়। পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেকে কোলের বাচ্চাও বিক্রি করে দেয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হয় সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর দেশের সার্বিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। দেশের মানুষ অনেকটা রিলিফনির্ভর হয়ে পড়ে। বিশ্বের কোনো অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে তা মনে করেননি। অনেকে বলেন, এই সদ্যঃস্বাধীন দেশটিতে না খেয়ে মারা যাবে কয়েক লাখ মানুষ। একজনও মারা যায়নি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণে। যদিও সেই সময় দেশে রিলিফচোরের অভাব ছিল না। ১৯৭৪ সালে পর পর বন্যা ও যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্য নীতির কারণে বাংলাদেশ যখন খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হলো, পরিস্থিতি মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধু বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে লঙ্গরখানা খুলে দুস্থদের মধ্যে বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণ। সেবার মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ২৪ হাজার মানুষের; যদিও অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল লাখখানেক মৃত্যু হবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১০টি দেশ বর্তমানে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কভিড-১৯-সৃষ্ট মহামারির কারণে। এই ভয়াবহ মহামারিতে এ পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার) সারা বিশ্বে এক কোটি ৫৩ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ছয় লাখ ২৪ হাজার মানুষের। এই মুহূর্তে আক্রান্ত ও মৃত্যুর শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারত। মহামারিটির উৎপত্তি চীনের উহানে গত ডিসেম্বরে। বিশ্বের মানুষ তা জেনেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। বাংলাদেশে এই মহামারি প্রবেশ করেছে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে এই মহামারির ভাইরাসের প্রবেশ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসা প্রবাসীদের মাধ্যমে। শুরুর দিকে এই মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলেও পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। এটি সম্ভব হয়েছে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি ও দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ নেওয়ার কারণে।
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দেশ, যেখানে এক শ্রেণির মানুষ সব কিছুতেই রাজনীতি খোঁজে। আর সরকারে যদি আওয়ামী লীগ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। সরকার বা শেখ হাসিনা যা কিছু করেন তার সব কিছুতেই একটা অন্তর্নিহিত মতলব খোঁজে।
দেখা যাক, বিশ্বের কয়েকটি উন্নত দেশে এই মহামারি কতটা ভয়াবহভাবে আঘাত করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। শুরুর দিকে এই দেশের প্রেসিডেন্ট কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে এই বিপর্যয়ের জন্য চীনকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে কামান দাগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই বলে আসছে, যেহেতু এই মহামারির কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, এর থেকে নিজেকে নিরাপদ থাকতে সর্বাগ্রে প্রত্যেক মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং মাস্ক পরতে হবে। ট্রাম্প জানিয়ে দিলেন, এই পরামর্শ তিনি মানেন না এবং এ-ও বললেন মাস্ক তো জঙ্গিবাদীদের জন্য প্রযোজ্য। ঘুরে বেড়াতে লাগলেন বেপরোয়াভাবে এবং একই কাজ করতে সবাইকে আশকারা দিলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহার করে নিলেন। বিভিন্ন শহরে ট্রাম্প সমর্থকরা মিছিল করল তাদের নেতার সমর্থনে। ফলাফল এই পর্যন্ত এক লাখ ৪১ হাজার মানুষের জীবনহানি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪০ লাখ মানুষ আক্রান্ত। মনে রাখতে হবে, প্রায় ৩৩ কোটি মানুষের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৩৪ জন মানুষ বাস করে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেকটা ব্যর্থ ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত মাস্ক পরে নিজের মুখ ঢেকেছেন। মুখ ঢাকার আগে ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘কেয়ামত নজদিক’।
ইউরোপে এই মহামারি প্রথমে যে দেশটিকে আঘাত করে সেটি জার্মানি, যার জনসংখ্যা আট কোটি ৩৮ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৪০ জন মানুষের বাস। মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ২০০ জনের। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তাঁর প্রজ্ঞার জন্য সর্বমহলে সম্মানিত। এই মুহূর্তে এই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ব্রাজিল। প্রায় ২১ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে কভিড-১৯ প্রবেশ করেছে একটু দেরিতে। প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর আচার-আচরণও অনেকটা ট্রাম্পের মতো। তিনি এখন নিজেই করোনায় আক্রান্ত। দেশটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ২৫ জন মানুষ বাস করে। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৮২ হাজার মানুষের।
দেখা যাক ইতালির অবস্থা, যেখান থেকে উড়োজাহাজে চড়ে কভিড-১৯ বেশ সম্মান নিয়ে ঢাকায় এসেছিল। যাঁরা এর সহযাত্রী ছিলেন তাঁদের সরকার কয়েক দিনের জন্য বিমানবন্দরসংলগ্ন হজ ক্যাম্পে সরকারি অতিথি করতে চাইল। না, তাঁরা আতিথ্য গ্রহণে একেবারেই নারাজ। একজন তো বাংলাদেশের গালেই চড় মেরে বসল। তারপর প্রশাসন সদর্পে যেতে দিল সবাইকে। সর্বনাশ সেখান থেকেই শুরু। দেশটিতে মানুষ আছে ছয় কোটির ওপর। বাঙালি অনেক। তাদের একটি বৃহৎ অংশ আবার সে দেশে গেছে অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বা মরুভূমির প্রখর তাপ ও কষ্ট জয় করে। দেশটিতে আবার বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি, যাঁদের বেশির ভাগই বৃদ্ধাশ্রমে অথবা নিজ বাড়িতে একাকী বাস করেন। এমন চিত্র ইউরোপের অনেক দেশে। বেশির ভাগ পরিবারে কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ২০৬ জন মানুষের বাস। দুই মাসের মধ্যে মহামারিতে মারা গেল ৩৫ হাজার। বুড়োরা আশ্রম বা বাড়িতে মরে পড়ে রইলেন। খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। এমনতর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও ঘটেছে।
১২৬ কোটি মানুষের দেশ ভারত। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩০০ মানুষ বসবাস করে। প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়টির ওপর যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল ততটা গুরুত্ব দেয়নি বলে ভারতের অনেক রাজ্য সরকার মনে করে। দেশটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এই মহামারিতে। পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে কেরালা, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গ কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও এখন পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তা স্বীকার করেছেন।
উল্লিখিত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান তো নস্যি। তবে বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বে এখন রোল মডেল। এখনো এই দেশটি তার এই অবস্থান যে ধরে রেখেছে তা আবারও প্রমাণিত হলো। এই দেশ বিশ্বে একটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত, যার মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির কাছাকাছি। এক হাজার ৩০০ মানুষ প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে। ঢাকা শহরেই দুই কোটি মানুষ বাস করে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশেই এত জনসংখ্যা নেই। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার ৭০০ মানুষ নিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের খেতাব নিয়ে এক নম্বরে আছে। বলেছি, শুরুতে সরকার বেশ অপ্রস্তুত ছিল পরিস্থিতি মোকাবেলায়। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশি দেরি হয়নি। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ না দিলে কার্পণ্য হবে। তিনি তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনকে পরিণত করলেন কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর হিসেবে। মাঠে নামালেন সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বিজিবিকে। মার্চের ২৬ তারিখ থেকে ঘোষিত হলো দেশে সাধারণ ছুটি। এই বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের অনেক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেরে ফেলে স্থগিত করে দিলেন বাকি সব অনুষ্ঠান। প্রথম দিকে সাধারণ মানুষকে বিনা প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে নিষেধ করা হলো। বেকায়দায় পড়ল যারা দিন এনে দিন খায় সেই সব মানুষ। তাদের সংখ্যা বেশ বড়। সিদ্ধান্ত হলো, তাদের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে। এই কাজে মাঠে নামলেন সেনা ও পুলিশ সদস্যরা। তাঁরা মানুষের বাড়ি বাড়ি খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছেন এমন দৃশ্য দেখে কার না ভালো লাগে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার উড়ে গেল খাদ্য নিয়ে। আক্রান্তদের চিকিৎসা দরকার। নির্দেশ দিলেন সব সরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড খোলার। প্রথম দিকে অন্যান্য দেশের মতো স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পোশাকের চরম ঘাটতি দেখা দিল। অনেক হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ছিল। সেসব বাধাও দ্রুত অপসারণের চেষ্টা করা হলো। বাংলাদেশ তো বর্তমানে বিদেশে সুরক্ষা পোশাক ও চিকিৎসার ওষুধও রপ্তানি করছে। কিছুদিনের মধ্যে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল এগিয়ে এলো করোনা চিকিৎসা দিতে। তবে তাদের সবার মতলব ভালো ছিল না। তাদেরও পাকড়াও করা হলো। এত কিছুর পরও বাংলাদেশে শনিবার পর্যন্ত করোনা রোগে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৮৭৪, সংক্রমিত হয়েছে দুই লাখ ২১ হাজার ১৭৮, আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে এক লাখ ২০ হাজার ৯৭৬ জন। জনগণ একটু সচেতন হলে পরিস্থিতি আরো ভালো হতে পারত। বাংলাদেশের জনগণের আইন না মানার আত্মঘাতী প্রবণতা সর্বজনবিদিত। এই দুর্যোগে হতাশ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা যে অন্য আর দশটি দেশের মতো ভয়াবহ হয়নি তার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তো দিতেই পারি। আবারও তিনি নেতৃত্বের পরীক্ষায় উতরে গেছেন। তাঁর প্রাপ্য তাঁকে দিতে কট্টর আওয়ামী লীগার হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজ দেশের সব কিছু সব সময় কালো না ভাবা ভালো।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক