করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির জন্য ৫৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। তহবিলের সংকট যেন না হয় এ জন্য কয়েক দফায় কমানো হয়েছে বিভিন্ন নীতি, সুদহার। শিথিল করা হয়েছে বেশ কয়েকটি নীতিমালা। এর পরও গত অর্থবছরের ঋণ বৃদ্ধির হার রেকর্ড পরিমাণ কম হয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোকে সুবিধা দিতে নতুন মুদ্রানীতিতে কিছু নীতিছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব ছাড় নিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয় মার্চ থেকে। সংক্রমণ এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করা এবং ক্ষতি কাটাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে। এ প্যাকেজের অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ হিসেবে বিতরণ করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তহবিলের সংকট না হয় সেজন্য ৫৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে সরকার। এর পাশাপাাশি নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) ও রেপো সুদহার দুই দফায় কমানো হয়। প্রবর্তন করা হয় ১ বছর মেয়াদি নতুন রেপো।
ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বাড়াতে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমাও বাড়ানো হয়। সরকারি বিল-বন্ড জমা রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এতসব সুবিধা নিয়েও গত মার্চ, এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির হার ছিল রেকর্ড পরিমাণ কম। মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এপ্রিলে তা আর কমে ৮ দশমিক ৮৩ এবং মে মাসে প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সর্বশেষ মাস জুন অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত কম ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে গত বুধবার ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া সরকারকে আগের তুলনায় ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ বেশি দিতে হবে।
করোনার কারণে ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের সংকট হতে পারে। এমন আশঙ্কায় মুদ্রানীতিতে ব্যাংকগুলোকে আরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো আরও সস্তায় নগদ অর্থ নিতে পারবে। এ জন্য কমানো হয়েছে ব্যাংক রেট, রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার। ১৭ বছর পর ব্যাংক রেট ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে আগের তুলনায় ১ শতাংশ কম সুদে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া তৃতীয় দফায় রেপো রেট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নিতে পারে ব্যাংকগুলো। আর রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণের মাধ্যমে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে কিছু সূচক বাড়বে বলে ধরা হয়েছে। এ জন্য নীতিসুদহার কমিয়ে ব্যাংকগুলোকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে ঋণ দেবে কিনা? প্যাকেজ ঘোষণা করলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করছে না ব্যাংকগুলো। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের স্বার্থে যেসব খাতে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন সেটি হবে কিনা এটাই প্রশ্ন। আমরা দেখছি ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে না এবং ঋণ দেওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
করোনার সংকটে ব্যাংকগুলোকে আরও কিছু নীতিগত সুবিধা দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি করতে হবে না। কুটির, কটেজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএসএমই) শিল্পে খেলাপি নীতিমালা শিথিল করে খেলাপি করার সময়সীমা বাড়িয়ে দ্বিগুণ এবং প্রভিশন সংরক্ষণের হার কমানো হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়বে না এবং এ খাতে ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও কমে যাবে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ঋণ দেওয়ার জন্য আগেই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখান থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা কী পরিমাণ ঋণ পেয়েছেন? এসব উদ্যোক্তার ঋণ এ সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অথচ ব্যাংকগুলো বড়দের ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত তদারকি বাড়ানো, যেন প্রয়োজন আছে এমন উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে পারেন।