বর্তমানে সারা পৃথিবী করোনা মহামারীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ৬ মাসেরও অধিক সময় ধরে করোনা ভাইরাস পুরো পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সবারই প্রথমদিকে ধারণা ছিল এ রকম পরিস্থিতিতে মানুষ হয়তো হবে অনেক বেশি সহনশীল ও মানবিক। কিন্তু বাস্তবে তা মোটেই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই ঘটছে নানারকমের দুর্নীতি ও অপরাধ। নারী নির্যাতন তথা পারিবারিক সহিংসতা সারা পৃথিবীতে এ সময়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কিন্তু কেন?
সাধারণত স্ত্রীদের স্বামীর কাছে সব সময় একটি অভিযোগ থাকে যে, স্বামীরা তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয় না, করোনার এ সময়ে বেশিরভাগ পুরুষই বাসায় থাকছেন। তা হলে তো এ সময়টা যে কোনো দম্পতির জন্য হওয়া উচিত ছিল ‘শ্রেষ্ঠ সময়’। তারা এ সময়টা তাদের মতো করে একান্তে কাটাতে পারতেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু তা হয়নি। মনে হচ্ছে, নারীর কাছে করোনার চেয়েও পারিবারিক সহিংসতা যেন আরও বেশি ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
নারীরা ঘরের মধ্যে তার কাছের পুরুষের দ্বারাই নানাভাবে এ সময়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রশ্ন হলো- কেন? বোধকরি এর যথার্থ উত্তর দিতে পারবেন মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরাই। তার পরও বলব- করোনার সময়ে অধিকাংশ পুরুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন, তারা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, তারা এতদিনের যে বাইরের নানা ধরনের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত ছিল তা থেকে বিরত আছেন (আরও অনেক কারণ থাকতে পারে)। এসব কারণ হয়তো পুরুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে। আর এই বাজে প্রভাবটি পুরুষ তার কাছের নারীর ওপর প্রয়োগ করছে।
আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশের বেশিরভাগই নারী আর্থিকভাবে সচ্ছল নন। পরিবারে তাদের ডিসিশন মেকিংয়ে ভূমিকা নেই বললেই চলে। তারা তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থান চিন্তা করে শতরকম নির্যাতন সহ্য করেও চুপ থাকেন।
নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে সহজ ব্যবস্থা রয়েছে (হাতের কাছে) তা তারা জানেন না। আর করোনার এ সময়ে নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তো ভাবতেই পারেন না। কিন্তু তাই বলে, নারীর ওপর যদি প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় তা কি সে অবলীলায় মেনে নেবে? আমাদের দেশে নারীরা সাধারণত ঘরে যৌতুক, দাম্পত্য কলহ, স্বামীর বহুগামিতা, পরনারীতে আসক্তি, সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। নারী ঘরের বাইরে বের হলে অচেনা পুরুষ দ্বারা যৌন হয়রানি/ইভটিজিং এমনকি ধর্ষণেরও শিকার হয়। মানসিক নির্যাতনকে আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিই না। কিন্তু বেশিরভাগ নারীই তার কাছের পুরুষের নানা কথায় বা আচরণ-ব্যবহার দ্বারা প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এর ফলে নারীর মধ্যে অবসাদ, উদ্বিগ্নতা ও অবিশ্বাস, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়।
এ পরিস্থিতিতে নারীর করণীয় :
১. চুপ করে নির্যাতন সহ্য করা নয়, নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই নারীর উচিত তার স্বজন/বন্ধু/শুভাকাক্সক্ষীকে জানানো।
২ . উপরে বর্ণিত অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে নারীকে তার মোক্ষম সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। আর তা হলো করোনার এ সময়ে নারী অন্য কারও সহযোগিতা যদি না পায় তবে এ সময় তার হাতের মোবাইল বা ল্যান্ডফোন থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় হেল্প সেন্টারের ১০৯ নম্বরে অবশ্যই ফোন বা এসএমএস দেবে। এই হেল্পলাইন সেন্টারটি সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে এ নম্বরে ফোন দেওয়া যাবে। জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারটি ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত। নির্যাতিত মহিলার হেল্পলাইন সেন্টারে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ১০৯ নম্বরে তার একটি ফোন বা এসএমএস করাই যথেষ্ট। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারটি প্রতিদিন আপনার সেবায় নিয়োজিত আছে।
মনে রাখবেন, ১০৯ নম্বরটি, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধেও সাহায্য দেবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। নারী ও শিশুর শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অগ্নিদগ্ধে, যে কারও দ্বারা উত্ত্যক্ততায় এ নম্বরে ফোন দেওয়ার বিকল্প নেই।
নারীর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এ নম্বরে কল করে সে কী সুবিধা পাবে?
সুবিধাগুলো হলো :
১. হেল্পলাইন সেন্টার আপনি কারও দ্বারা নির্যাতিত বা ঝুঁকিতে আছেন জানলে আপনাকে রক্ষা বা উদ্ধার করার জন্য প্রথমত ব্যবস্থা নেবে।
২। আপনাকে পুলিশি সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এর ফলে নারীর কাজ আরও সহজ হবে। যেহেতু করোনাকালীন নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া সীমিত, সেখানে নিজে থেকে থানায় যাওয়ার কথা তো অনেক নারীই ভাবতে পারেন না। হেল্পলাইন সেন্টার ভিকটিমের একটিমাত্র ফোন কলেই নির্যাতিত নারীর জন্য পুলিশি সাহায্যের ব্যবস্থা করবে।
৩। আইনগত সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে, যার ফলে নারীর ধকল অনেকখানি কমে যাবে।
৪। টেলিফোনে সমস্যার সমাধানে কাউন্সিলিং করা হবে। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে থানা-পুলিশ লাগে না, দুজন মানুষের প্রয়োজন হয় যথাযথ কাউন্সিলিংয়ের। কাউন্সিলিং সুবিধাও হেল্পলাইন সেন্টার দিয়ে যাচ্ছে।
৫। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যেসব সংস্থা কাজ করে তাদের সঙ্গে ভিকটিমকে প্রয়োজনানুসারে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে একজন নারীর প্রচ- সুবিধা হবে, কারণ আমাদের দেশের নারীদের পক্ষে এখনো (বিশেষত করোনাকালীন) বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এক সময় যোগাযোগ করা বেশ কষ্টকরই বটে। নারীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়ার জন্যই হেল্পলাইন সেন্টার নিয়োজিত। দরকার শুধু ভিকটিমের একটিমাত্র কল।
৬। ভিকটিমকে প্রয়োজনে মেডিক্যাল সার্ভিসও দেওয়া হয়।
৭। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হেল্পলাইন সেন্টার সালিশেরও ব্যবস্থা করে দেয়।
যারা এই হেল্পলাইন সেন্টার থেকে সুবিধা নিতে চান তারা অবশ্যই সঠিক, সত্য, প্রকৃত তথ্য ১০৯ নম্বরে ফোন করে জানাবেন। অহেতুক কারও প্রতি প্রতিহিংসাবশত এ নম্বরে ফোন দিয়ে হেল্পলাইন সেন্টারের সময় অপচয় অবশ্যই কাক্সিক্ষত নয়।
অর্থাৎ ফোন নং ১০৯। বর্তমানে এ নম্বরটি জানা সব নারীর জন্য জরুরি। ১০৯ নম্বরটি সব সময় মাথায় রাখুন। প্রয়োজনে আপনার নোটবুকে এ নম্বরটি টুকে রাখুন। হাতের কাছে যেহেতু সহজে নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ রয়েছে তবে বাইরে যাওয়া কেন? ফোন করুন। নিজে অত্যাচার থেকে বাঁচুন এবং একজন অপরাধীকে ধরিয়ে দিন।
নিজে ১০৯ নম্বরটি জানুন, অন্যকে জানান। আপনার চারপাশে অসংখ্য পরিচিত নারী আছেন যারা নানাভাবে প্রতিনিয়ত কারও না কারও দ্বারা শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, কিন্তু তিনি এ থেকে মুক্তির পথ জানেন না। চোখের পানিই কেবল ফেলছেন তিনি, চারপাশের অনেকেই হয়তো তাকে দূরের জটিল সমাধানের পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু ভিকটিমের হাতের মুঠোতেই যে আছে অসহ্য কষ্ট থেকে মুক্তির পথ, তা কী সে জানবে না? অবশ্যই সে জানবে ১০৯ নম্বরটি, কল করে সহায়তা নেবে এবং ঘরে বসেই পাবে তার কষ্ট থেকে পরিত্রাণ।
চলুন, আজ থেকে আমরা নিজের প্রিয় মানুষটির ফোন নম্বর যেমন মাথায় রাখার চেষ্টা করি, তেমনি মাথায় গেঁথে ফেলি ১০৯ নম্বরটিকেও। নিজের ভালো থাকা তো হাতের মুঠোতেই আছে, তা হলে আর এত চিন্তা কীসের?
মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক